Monday, 13 April 2015

ভুতের ছানা

                                        “ভূতের ছানা”
                     
আমি বর্ধমানের এক গ্রামের ছেলে।কলকাতায় এসেছি চাকরির সন্ধানে।সকাল থেকে সন্ধ্যা, টালা থেকে টালি গঞ্জ দৌড়ে বেড়াই কাজের খোঁজেকোথাও কিছু লাগছেনা লাগছেনা হঠা এক বন্ধু একজনের একটা ঠিকানা দিয়ে বলল-“ এনার সঙ্গে দেখা কর।ইনি নাম করা একজন আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন।এনার উঙ্গুলি হিলনে অনেক কিছুই হয়।দেশ বিদেশে ওনার অনেক নামডাক অনেক প্রতিপত্তি”।  
বললাম-“শেষে কিনা মাফিয়া ডন?তা চেনা নেই শোনা নেই, উনি পাত্তা দেবেন কেন আমাকে”?
সে বললে-  “গিয়েই দেখ না একবার”? ভাবলাম-“ পেটের দায় বলে কথা? দেখাই যাক”  
গুটি গুটি পায়ে একদিন ঠিকানা ধরে হাজির হলাম সেখানে গিয়ে।প্রথম দিন ও তার পরের তিন দিন শুধু বেল বাজানই সার হল।কেউ সাড়া দিল না।  বন্ধুকে বলতে, “সে বললে এরকমই হয়। উটকো লোককে ওরা হঠাৎ করে দরজা খুলে দেয় না।তুই লেগে থাক”।পঞ্চম দিনে চাকর বাকর গোছের একজন দরজা খুলে বসার ঘরে পৌঁছে দিয়েই চলে গেল।বসতেও বললে না।আমার কেমন যেন মনে হতে লাগল যে আমার উপর কেউ নজর রাখছেকোথাও লুকন ক্যামেরা থাকতে পারেখনিক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে থেকে, ঘরের কোনে রাখা একটা কাঠের টুলে বসলাম।সোফায় বসার সাহস হল না। অনেক্ষন বসে আছি তো বসেই আছি কারো কোন সাড়া শব্দ নেই।হঠা লক্ষ করলাম যে দরজার পর্দাটা অল্প অল্প নড়ছে। তারপর ঘরে ঢুকল স্লিপিং স্যুট পরা বছর পাঁচেকের অসম্ভব রোগা একটা ছেলে। ছেলেটির হাবভাব চালচলন সবই অস্বাভাবিক ও অদ্ভুত। সে মাথাটা ডানদিকে সামান্য একটু হেলিয়ে, এক দৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললে আংকেল আংকেল  আমাকে একটা ভূতের ছানা এনে দেবে?
শুনে আমি  তিনবার খাবি খেলাম । অবাক হয়ে বললাম-“ভূতের ছানা? কি করবে তুমি তাকে দিয়ে”?
“তার সঙ্গে খেলব”  
“কেন মানুষের ছানারা তোমার সঙ্গে খেলেনা”?
 ছেলেটা আরও একটু আমার কাছে সরে এল । তারপর খুব একটা গোপন কথা বলার মতো করে আসতে আসতে  বললে- আসলে আমি তো অসুস্থ্, ওদের সঙ্গে ছুটতে পারিনা, তাই ওরা আমায় খেলা  নেয় না
ভারি বিপদে পড়ে গেলাম আমিআশা ছিল চাকরি বাকরি একটা কিছু হয়ে যাবে কিন্তু শেষে যে এ রকম ভূতের ছানার পাল্লায় পড়তে হবে তা কে জানত? তবে ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন কিছু নয়।অনেক দিন থেকেই কাজ খুঁজছি, আর অনেক রকম অভিজ্ঞতা ও হচ্ছে।অনেক সোর্স ওলা বড় মানুষেরা আমার মতো গরীব চাকুরী শিকার সন্ধানীদের তাড়ানর জন্য কুকুর লেলিয়ে দেনঅনেকে আবার ঠিক অতটা রুঢ় না হয়ে বাড়ির ছোট ছেলেপুলে দের লেলিয়ে দিয়ে, চকলেটটা, আইসক্রিমটা, বায়না করান। তবে ভূতের ছানাটা একেবারে লেটেস্ট    
কাল আনব বলে তখনকার মতো পালিয়ে বাঁচলাম।কিন্তু বাসায় এসে মনটা খচখচ করতে লাগল। হাজার হোক নিঃসঙ্গ একটা অসুস্থ্ বাচ্ছাকে যখন কথা দিয়েছি, তা রাখতেই হবে।কিন্তু ভূতের ছানা  পাই কোথায়?কথাটা আমার রুমমেট কে বলতে সে হেসে বললে-“বাঃ হেভী লেভেল দিয়েছে তো বাচ্ছাটা, শোন তুই এখন থেকে ওখানে যাওয়া বন্ধ কর”। বললাম- কেন?   
-“কেন আবার? এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে ওর বাবা তোকে ঝেড়ে ফেলার জন্যে ছেলেকে দিয়ে এসব বলিয়েছে”আমি বললামি-“ না, ওরকম ছল চাতুরী তথা কথিত ভদ্রলকেরাই করে। আন্ডার ওয়ার্ল্ড  দুনিয়ার লোকেরা বাজে সময় নষ্ট করে না। যাকে অপছন্দ , সোজা তার মুণ্ডুটা নামিয়ে দেয়, আর  সেটাই দস্তুর”  
–“ তুই তা হলে ভূতের ছানা খুঁজবি”?
-“আলবাত খুঁজব।এবং সেটা এখান থেকেই শুরু করব”
“তা কর, তবে কোন লাভ হবেনা। আরে ভূত থাকলে তো তবে তাদের ছানা পোণার কথা”?  
 আমি বললাম-“ভূত যদি না থাকবে তবে সরকারী পয়সায় ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হয় কী ভাবে? সুতরাং ভূত আছে।এবং তাদের বাপ যখন আছে, তখন ছানাপোনা ও বৌ বাচ্ছা থাকার সম্ভাবনা ও শতকরা একশ ভাগ”।
-“ঠিকাছে ভূতের ছানা যদি থেকেও থাকে তারা শুধু শুধু ধারা দেবে কেন? আর যদি ধরা দেয়ও তবে তোর কথায় ওই বাচ্চাটার সঙ্গে খেলতেই বা রাজি হবে কেন”?    
ওর কথার যুক্তি যে নেই তা নয়, তবে চেষ্টা তো করতেই হবে।   
 সারা রাত চিন্তা করে করে ভাল ঘুম হল না। ভোর বেলা  উস্কখুস্ক চুল, বসা চোখ নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো উদাস হয়ে বারাণ্ডার রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।বাড়িওয়ালার মেয়ে ছবির সঙ্গে দেখা।ও মর্নিং কলেজে বেরনর আগে কলঘরে যাচ্ছেভারি ফাজিল মেয়ে, আমায় দেখে হেসে বললে-“কী কাকু কাকীর লগে ঝগরা হইসে নিহি?মুখ খান অমন শুকনা শুকনা ক্যান”? একে আমি মরছি নিজের জ্বালায়, ইনি  আবার এলেন ইয়ার্কি দিতে? বললাম- “খবরদার বলছি কাকু বলবি না।আমি তোর থেকে বড়জোর দুই কি তিন বছরের বড়।কাকু কিরে? দাদা বলতে পারিস না?সে মুখ বেঁকিয়ে বললে-“ হুঃ দাদা? একদিনও ঝাল মুড়ি ফুচকা খাওয়াইলে না, আবার দাদা”?ঝট করে আমার মাথায় খেলে গেল যে অনেক ব্যাপারে ছেলেদের থেকে মেয়েদের মাথা ভাল খেলে। মিষ্টি করে বললাম –“এই ছবি শোন একটা খুব খ্যাচা কলে ফেঁশে গেছি, একটু বুদ্ধি দিবি”?ছবি খুব সিরিয়াস মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। বললে-“ যা  বলার তারাতারি বল।কলঘরে লাইন পইড়া যাবে” বললাম তুই তাহলে ঘুরেই আয়।তারপর বলব।অনেক বড় ব্যাপার তাড়াতাড়ি হবে না”।ছবি চলে যেতে আবার চিন্তা শুরু হল,-“ হ্যাঁ ছেলেটা আর বায়না খুঁজে পেল না?শেষে কিনা ভূতের ছানা? ভূতের ছানা কি আর কুকুর ছানা না ছাগল ছানা? যে গলায় গামছা বেঁধে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে নিয়ে যাব? ধাড়ি হউক বা ছানা? দস্তুর মত একটা ভূত বলে কথা? তাপর ছানা নিয়ে টানা টানি করলে  তাদের বাপ মায়েরা কি ছেড়ে কথা বলবে? দেখি ছবি কি বলে?
ছবি ফিরে এসে বলল-“এবার বল”? যতটা সংক্ষেপে সম্ভব বললাম।এক মিনিট চিন্তা করেই ও আমার কানে কানে আইডিয়াটা দিয়েই ও বারাণ্ডা ধরে ছুটে চলে গেল। আর যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল -“আজ সন্ধ্যায় ফুচকা খাওয়াতে  হবে কিন্তু। আশ্চর্য  মাথা  বলতে হবে  মেয়ের? যাইহোক ওর কথা মতো লাল নীল ছোট  ছোট কয়েকটা মাছ সহ একটা জল ভর্তি বয়ম নিয়ে হাজির হলাম সেখানে। ছেলেটি কে ডেকে ওটা দিতে, সে কিছুক্ষণ মাছ গুলর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল- “এরা কি ভূতের ছানা”?
আমি অম্লান বদনে বললাম- “ হ্যাঁমহিষাসুর যেমন মহিষের পেটে লুকিয়ে ছিল,ভূতের ছানারা ও  তেমনি এই মাছের ছানাদের পেটের ভিতর লুকিয়ে আছে”।  
ও জানতে চাইল- “ এরা কি খায়”?
ছোট্ট একটা ড্রাই ফুডের কৌট দেখিয়ে বললাম “ ওরা এটা আর চাঁদের আলো খায়”।  
চাঁদের আলো খায় শুনে  ছেলেটির বিষণ্ণ নিষ্প্রভ  মুখে একটা হাসি্র ঢেউ খেলে গেল।
 সে আনন্দে দুহাত তুলে নাচতে লাগল। তার আনন্দ দেখে আমি এমনই মোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে টের পাইনি, কখন একজন মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ওলা গোলগাল ফর্সা ভালো মানুষ চেহারার ভদ্রলোক ঘরে ধুকেছেন।ইনি নিশ্চই ছেলেটির পিতা।
অথচ এঁর মধ্যে মাফিয়া মাফিয়া ভাব একেবারেই নেই।তাই আমি আবাইলাম। তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। 
              
  তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

  পয়লা বৈশাখ ১৪২২ সন