Monday, 18 July 2016

ছিন্নমূল (১)

                              ছিন্নমূল (১)
দাউ দাউ করে জ্বলছে বনআর গল গল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে ওর ঘরের জানালা  দরজা দিয়ে
কারা সব হৈ হৈ করে লেগে পড়েছে ওর ঘরের চারিধারে বনে আগুন লাগাতে
ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসল অতসী। দরদর  করে ঘামছে,  আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।  ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একি রকম দুঃস্বপ্ন ও প্রাই দেখে ।   
গাঁয়ের একেবারে শেষপ্রান্তে, বনের মাঝে তাল পাতায় ছাওয়া অতসীর ঘর। অতসীর ঘর না বলে ,   ওর মায়ের কুঁড়ে বললেই ঠিক বলা হত। ওর মা আর ও  দুজনে মিলে থাকত এই হেলে পড়া মাটির ঘর খানায়।  লোকে বলত অতসীর মা নাকি ডাইনি বিদ্যে জানে। তাই ছোটর থেকেই ওর  ভয় ছিল যে, কোন না কোন দিন  গাঁয়ের লোকেরা ওদের পুড়িয়ে মারবে। সেই আশঙ্কা থেকেই বার বার এই দুঃস্বপ্ন দেখা। কিন্তু ও বা ওর মা, কোনদিন কারও কোন ক্ষতি করেনি। পারলে সাধ্য মতো  উপকারই করেছে তাই সজ্ঞানে ও কখনো  ভাবেনি যে বাস্তবে সত্যি সত্যিই একদিন এমনটা ঘটবে, ওদের ঘরে কেউ আগুন দেবে  
অতসীর মা  একটা তারের খেলনা বেহালা বাজিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে হাল্কা পলকা জিনিস পত্র, এই  যেমন  বচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের চুলের কাঁটা,  চিরুণী, আয়না, সেফটিপিন,  বটতলার বই প্ত্র- ছোটদের রামায়ন, মেয়েদের ব্রতকথা ,ধারাপাত, এই সব ফেরি করে বেড়াত। আর তার পিছু পিছু  নাচতে নাচতে খেলে বেড়াত অতসী। একটু বড় হতে সে জিজ্ঞাসা করেছিল তার মাকে-“ হ্যাঁরে মা তুই সত্যিই কি ডাইনি বিদ্যে জানিস নাকি রে”?
মা ওকে আদর করে বলেছিল-“ দূর পাগলী,সে বিদ্যে জানা থাকলে আমি কি আর খেটে খাই? না  আমাদের এমন দশা হয়? নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। ছেঁড়া পুরন কানি পরে ঘুরতে হয়”?  
–“ তাহলে ওরা যে বলে”?
-“ বলুক, আসলে দুষ্টু লোকেদের দূরে রাখতেই বলেছি যে আমার ঘরের ধারে দেখলে, তোদের হাড় মাস চিবিয়ে, রক্ত চুষে খাব। সেই থেকেই রটে গেছে  যে আমি নাকি ডাইনি। আমি ম’লে তুই  ও অমনি ডাইনি সেজে থাকবি। দেখবি কেউ বিরক্ত করতে সাহস পাবে না।
বনের মাঝে অতসীদের ঘর, ছোট থেকেই অতসী ঝোপে জঙ্গলে জলার ধারে একা একা ঘুরে বেড়ায়নিজের মনে কথা কয়, গান গায়। গাঁয়ের লোকে বলে, এক রত্তি মেয়েটার কাণ্ড  দ্যাখ? সাহস ও বলিহারি, আর ওর মায়ের আক্কেলটাই বা কি? অতটুকু একটা বাচ্চাকে  কি অমনি করে  ছেড়ে  দিতে হয়? কেউ কেউ বলে সাহস হবে  নাই বা কেন?কার মেয়ে দ্যাখ? ডাইনির মেয়ে যে? তোমাদের ছেলে পুলেদের বাপু সাবধানে রেখ, মিশতে দিয়নি  ওর সাথে।
অতসীর সঙ্গে ওদের গাঁয়ের কেউ মেশে না। তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ওর বন্ধু বনের পশু পাখী আর তাদের ছানা পোনারা। ও বেঁজীর ছানা, শেয়ালের ছানাদের কোলে তুলে আদর করে।  এমনকি গাছ গাছড়া দের সঙ্গেও ঘুরে ঘুরে কথা বলে ও কে জানে নিজের মনে  কি বক বক 
করে ? গাছেরাও নাকি ওর সঙ্গে  কথা বলে ও যখন একটু বড় হ’ল, এক এক দিন ওর মা  ওকে ঘরে একা রেখে কাজে বেরিয়ে যেত।  বেরনর সময়  বলে যেত - “সাবধানে থাকবি, বনে জঙ্গলে বেশী টো টো করে ঘুরে বেড়াবি না”। অতসী ভাবে সাবধান আবার কার থেকে? ও তো আর গাঁয়ের দিকে যাচ্ছেনা ? ভয় তো সেখানেই যেখানে মানুষের বাস।বনের পশুরা তো ওর বন্ধু। তারা কাল যা  ছিল আজও তাই আছে। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হয় না।কাল যে তোমার  বন্ধু  ছিল আজ সে বিনা কারনে ঝগড়া করতে পারে।  আর বনেই যদি না বেড়াল তাহলে আর ঘরে  থাকা কেন? সে সব দিন ও জলার  ধারে  গিয়ে চুপটি করে বসে থাকত। বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবত।-কত হবে এই জঙ্গলের বয়স? কে বানাল এই সব গাছ পালা,পশু পাখী, জলা আর জলার  মাছেদের? মায়ের কাছে শুনেছে যে, আগে নাকি এখানে গ্রামটাম  কিছুই ছিল না। ছিল শুধু বিশাল  এক জঙ্গল। সে জঙ্গলে দিন মানেও আলো ঢুকত না।  নির্ভয়ে  ঘুরে বেড়াত রাজ্যের যত পশু পাখীর দল। ধীরে ধীরে মানুষের বসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বন আর নেই। নেই সেই  সব পশু পাখীর দলও এমন কী দেখা যায় না সেই আগের মতো প্রজাপতি আর মৌমাছি দের ।  তারা সব কে কোথায় যে চলে গেছে কে জানে? দেখা মেলা ভার ধান ক্ষেতের মাছেদের ও। ওর মনে  পড়ে, ও যখন খুব ছোট ছিল, এক এক বর্ষার রাতে, ও আর ওর মা মিলে নালা থেকে কত রকম মাছ ধরেছে। কিন্ত এখন পোকা মারার বিষে আর বিদেশী মশলা সারে ধান ক্ষেতের সে সব মাছ লোপাট হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে অসংখ্য বক জাতীয় পাখি, যাদের একমাত্র  খাদ্য ছিল ক্ষেতের ওই সব মাছ আর পোকা মাকড়  
এই রকম চলতে থাকলে, দেশে একদিন একা মানুষ ছাড়া আর অন্য কোন প্রাণীর দেখা মিলবে না। কেমন হবে সে পৃথিবী?  তখন এদের ছাড়া দেশের মানুষ বাঁচবে তো? ভাবতেও ভয় করে ওর।
ছায়াঘন শান্ত শীতল জলার পাড়ে চুপটি করে  বসে প্রকৃতির লিলা খেলা দেখতে দেখতে এক সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলত সেভারি ভাল্লাগত ওর, যখন দেখত ডাহুক কাদা খোঁচা আর বকেরা  দৌড়াদৌড়ি   করছে তাদের লম্বা লম্বা পা ফেলে। খঞ্জন আর ছাতারে পখী গুলো ল্যাজ দুলিয়ে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে । ডেকে বেড়াচ্ছে ঘুঘু  হরিয়াল আর হাঁসেরা। গাছের ডালে উদাস হয়ে বসে থাকা একটা মাছরাঙা, হঠাৎ ঢিল পড়ার মতো  আছড়ে পড়ল জলের বুকে ডুবে ডুবে  খুঁটে তুলছে শামুক গুগলি,  লম্বা গলা কালো পানকৌড়ি গুলো হাওয়ায় দুলছে সবুজ টিয়ার ঝাঁক, নারকেল গছের সবুজ পাতায় বসে।  দূর থেকে ভেসে  আসছে কাঠ ঠোকরার একটানা ঠক্ ঠক্ শব্দ আর উদাস গলায় নিঃসঙ্গ কোকিলের ডাক। হঠাৎ কখনো বনভূমির নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙ্গে তীক্ষ্ণ স্বরে  ডেকে উঠে ,সাদা মাথা সাদা বুক  শঙ্খচিল।  খেঁকশিয়ালী ছুটে যায়, মেটে খরগোসের পিছনে ধাওয়া করে। ঘোঁত ঘোঁত করে জলায় জল খেতে  আসে ছানা পোনা নিয়ে এক  পাল  বন শূকর। বেশ লাগত ওর সারাটা  দুপুর জলার ধারে বসে এসব  দৃশ্য দেখতে। তবে  সে সব এখন  অতীত। মা মারা যাবার পর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাকে বের হতে হয় ঝোলা  কাঁধে, ঝুড়ি মাথায়, বেহালা হাতে গাঁয়ের পথে গঞ্জের হাট যেতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয় , মাঝে আবার  পড়ে  দমদমার মাঠ । সে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দেখা যায় না।পেরুতে  লাগে পাক্কা একটি ঘণ্টা। বনের ঘুম ভাঙ্গে গাঁয়ের আগে আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে অতসীরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।                                                    ক্রমশ ঃ-