পাওয়ার অফ
অবসার্ভেশন
banerjeetarunkumar@yahoo.com
অলোক সোম মহাশয় ব্যাঙ্ক থেকে সদ্য ভি আর এস নিয়ে, রাত দিন শুধু রহস্য রোমাঞ্চ
সিরিজের গল্প উপন্যাস পড়েই সময় কাটান ।এটা নতুন কিছু নয়, এ সব বই তো অনেকেই পড়েন। তবে অন্যদের সঙ্গে ওনার তফাৎটা হলো , উনি পড়ার
সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাথাটাও খাটান । এবং গল্পের গোয়েন্দা
রহস্য ভেদ করার আগেই উনি নিজে সেই রহস্যটি ভেদের চেষ্টা করেন। এবং নিজেকে
তিনি একজন বড় মাপের গোয়েন্দা বলেই ভাবেন। এ ব্যাপারে তাঁর
প্রিয় গুরু সার্লক হোমস। তিনি মনে মনে ঠিক
করে রেখেছেন যে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে
নিজের নাম রাখবেন ‘স্যার অলোক সোমস’ অনেকটা সারলক হোমস এর মতোই
শোনাবে। কিছু দিন আগে কবি গুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের নোবেল পদকটি চুরির খবর শোনা
মাত্র তিনি শান্তিনিকেতনে , অকুস্থলে গিয়ে হাজির হন। এবং স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করেন ।কিন্তু কাজটা বেশী দূর এগোয়নি।
কারণ কয়েক জন ষণ্ডা মার্কা আপাত নিরীহ
চেহারার লোককে সেখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়, এবং তাদের তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করার চেষ্টা করেন। ফল হয় উলটো, তারাই তাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে টানা দুদিন
লকআপে রেখে জেরায় জেরায় জেরবার করে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেয়।তারপর থেকে অলোক বাবু
সাবধান হয়ে গেছেন। প্রতিজ্ঞা করেছেন যে নো মোর ফ্রি লেন্সিং।এখন থেকে বিনা এ্যাপয়েন্টমেন্টে
তিনি তদন্তে নামবেন না । তবে মাথাটা খাটাবেন এবং মগজাস্ত্রে শান দেবেন। এই মাথা
খাটানর তাগিদে, সকাল সন্ধ্যা তিনি, তিন তলার ফ্ল্যাটের বারাণ্ডায় বসে নীচের বাস রাস্তার উপর নজর রাখেন
। এই নজরদারিটা ভালো ভাবে করার জন্য তিনি এক জোড়া শক্তিশালী দূরবীন কিনেছেন ও দূরদৃষ্টি
সম্পন্ন হয়েছেন। এতে পথ চলিত লোকজন গাড়ি ঘোড়ার উপর নজরদারিটা বেশ ভালোভাবে করা
যায়।তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস এই সব পথ চলতি লোকেদের মধ্যে অনেক অপরাধী লুকিয়ে আছে।তিনি
হাঁটা চলার ধরণ দেখে তাদের শনাক্ত করবেন । কিন্তু এখন
দরকার একজন ভালো সহকারীর। কারণ সব বিখ্যাত
গোয়েন্দাদেরই একজন করে ভালো সহকারী থাকে। অলোক বাবুর এটাই দু;খ যে তিনি এখনও তপসে , মানিক, বা ডাঃ ওয়াটসনের মতো একজন যোগ্য সহকারী যোগাড় করে
উঠতে পারেননি। গোয়েন্দাদের সহকারী হবার প্রধান যোগ্যতা হ’ল , তাকে নির্বাক শ্রোতা
হতে হবে। গোয়েন্দার সব কাজকর্মের উপর তার অগাধ আস্থা থাকতে হবে।তিনি একবার ভেবে
ছিলেন যে তাঁর স্ত্রী রমা দেবীকে সহকারী বানাবেন।কিন্তু একে তো রমা দেবী নির্বাক
নন, তার উপর অলোক বাবুর কোনো কাজকর্মের উপর তাঁর বিন্দু মাত্র আস্থা নেই।শুধু তা ই
নয়, তিনি যে অলোক বাবুর থকে বেশি বুদ্ধিমতী সেটা প্রতি নিয়ত বুঝিয়ে থাকেন।এবং সব
সময় অনাস্থা প্রস্তাব হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ফলে তাকে দিয়ে হবে না । এখন এক মত্র ভরসা তাঁর বড় শ্যালক গোবিন্দ। সে স্বল্পভাষী,
অলোক বাবুকে ভক্তি শ্রদ্ধাও করে খুব। সুতরাং তিনি ঠিক করলেন তাকেই
সহকারী বানাবেন। পুজর পর প্রতিবার সে ঠিক এই সময়েই বিজয়া করতে আসে। এবার এলে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে
দেবেন যে তিনি কতো বড়ো মাপের একজন গোয়েন্দা হয়েছেন। সেই মতো সব
ঠিকঠাক করে তিনি প্রস্তুত হলেন। এবং নিত্য প্রথামতো বারাণ্ডায় বসে দূরবীন দিয়ে
নজরদারী চালাতে লাগলেন। বেশী দিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হল না। এক রবিবার সকালে তিনি
যথারীতি বারাণ্ডায় বসে দৈনিক সংবাদ পত্রের
পাতা উল্টে রহস্যের সন্ধান করছেন ( যদিও এটা আসলে সকারীদেরই কাজ ) আর মাঝে মাঝে দূরবীন দিয়ে নীচের রাস্তা দেখছেন।হঠাৎ নজরে পড়ল উলটো দিকের বাস স্টপেজ থেকে
রাস্তা পার হয়ে গোবিন্দ এদিকে আসছে। হাত একটা মিষ্টির হাঁড়ী । তিনি আর কাল বিলম্ব
না করে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বোঁ করে ঘরে ঢুকলেন । তারপর ডাইনিং টেবিলে সদর দরজার দিকে পিছন করে ,সাত দিনের পুরন একটা খবরের কাগজে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন। এবং
গভীর মনোযোগ সহকারে কাগজ পড়ার ভান করে দরজায় কলিং বেলের প্রতীক্ষা করতে থাকলেন। পাঁচ মিনিট পরেও বেল না বাজায় তাঁর উৎকণ্ঠার মাত্রা
বেড়ে গেল। - কি হ’ল? এতক্ষণ তো লাগার তো কথা নয়? ইনভার্টারের দিকে চেয়ে বুঝলেন যে লোড শেডিং চলছে, লিফট বন্ধ। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছে তাই সময় লাগছে। কলিং বেল বাজল। অলোক বাবু একই ভাবে বসে, কাগজ থেকে মুখ না তুলে, স্ত্রী রমা দেবীর উদ্দেশ্যে
বললেন- “শুনছ ? দরজাটা খোলো তো ? মনে
হচ্ছে বর্ধমান থকে গোবিন্দ এসেছে”? ইচ্ছে
করেই তিনি কথা গুলো বেশ জোরে চেঁচিয়ে বললেন, যাতে দরজার বাইরে থেকে গোবিন্দ তা শুনতে পায় । দরজা খোলা মাত্র গোবিন্দ ঘরে ঢুকে
অলোক বাবুকে ওভাবে পিছন ফিরে কাগজ পড়া অবস্থায় দেখে অবাক হ’ল। অলোক বাবু একই ভাবে
বসে থেকে কাগজ থেকে মুখ না তুলে বললেন – এস এস গোবিন্দ তা বাড়ির খবর সব ভালো তো ?
সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলে কেন ? লিফট বন্ধ বুঝি ?
তা আবার মিষ্টিফিস্টি আনতে গেলে কেন? গোবিন্দ
ভীষণ অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অলোক বাবু তার মধ্যেই
বলে উঠলেন – তারপর বর্ধমানের নাপিতরা কি সব স্ট্রাইক করেছে নাকি ? দুদিন দাড়ি
কামাওনি কেন? গোবিন্দ মিষ্টির হাঁড়িটা কোনো রকমে দিদির হাতে
দিয়ে, অলোক বাবুর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললে- কি
করেছ গুরু ? পায়ের ধূলো দাও, তুমি তো
সাক্ষাৎ সার্লক হোমস হয়ে গেছো ? অলোক বাবু
সস্নেহে গোবিন্দর মাথায় হাত দিয়ে স্মিত হেসে বললে – দূর পাগল, এ আর এমন কি? এখানে
গুরু হোমস থাকলে তোমার বাসের নম্বরটাও বলে দিত। একটু আগে খেয়াল করলে, সেটা অবশ্য আমিও পারতাম । তা তুমি হঠাৎ ট্রেনে না এসে সোজা বাসে এলে কেন?
গোবিন্দ বললে- নাঃ শুধু গোয়েন্দাগিরি করে
এতো কিছু বলা সম্ভব নয় ? তুমি নিশ্চই আন্য কোনো বিদ্যা শিখেছ? বা যোগ বলে সিক্সত সেন্স কে
জাগিয়েছ। অলোক বাবু খবরের কাগজটা মুড়ে রেখে,
গোবিন্দকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে,
বললেন – শোন গোবিন্দ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে কিছু
নেই ।যদি তুমি পঞ্চ
ইন্দ্রিয়কে সব সময় সজাগ রাখতে পার আর তার সঙ্গে মাথাটাকেও খাটাতে পার, তাহলে অনেক
অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারবে।
- কিন্তু দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে এগুলো
তুমি বললে কি ভাবে? এর পিছনে কোনো লজিক তো নিশ্চই আছে ?
- অবশ্যই আছে। আমরা মানে গোয়েন্দারা কোনো ম্যাজিশিয়ান
বা অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন বাবাজী নই । আমরা যা কিছু করি বা বলি তার সব কিছুর পিছনে
সুচিন্তিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে।
- বেশ শুনি তবে তোমার কি ব্যাখ্যা ?
গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে অলোক বাবু শুরু
করলেন
- দেখ গোবিন্দ এর জন্য প্রথমে চাই পাওয়ার অফ অবসার্ভেশন ।
- আর সেটা নির্ভর করছে তোমার বায়নাকুলারের পাওয়ারের উপর।
রান্না ঘর থেকে বললেন রমা দেবী।
- আঃ , এর মধ্যে আবার বায়নাকুলার আসছে কোথ্থেকে ? বললেন
অলোক বাবু ।
- বিদেশ থকে।
- ইয়ে মানে আমি ঐ বিদেশ থেকে বায়নাকুলারটা আনিয়েছিলাম কিনা?
সেটাই তোমার দিদি বলছে । হ্যাঁ যা বলছিলাম, দেখ প্রতিটি মানুষের কলিং বেল বাজানর ধরনটা
আলাদা হয়। তোমার যদি শার্প পাওয়ার অফ অবসার্ভেশন থাকে এবং সেই সঙ্গে তুমি যদি প্রখর স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন হও তাহলে দরজায় কলিং
বেলটা কে টিপল তুমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারবে ।
- কিন্তু আমি লিফটে না উঠে যে সিঁড়ি ভেঙ্গে
উঠেছি, সেটা কি করে বুঝলে ?
- খুবই সহজ , একটা মানুষ সোজা লিফটে উঠে এলে
শব্দটা যেমন হয় , সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠলে সেটা একটু অন্য রকম হবে।
- আর ট্রেনে না এসে যে বাসে এসেছি তা কি করে বুঝলে?
- তোমার ঘড়ির সট্র্যাপের নীচে যে বাসের
টিকিটটা দেখা যাচ্ছে , সেটা লম্বাটে আর কাগজটা মোটা। কলকাতার বাসের টিকিট পাতলা
কাগজের হয় ।
- গালের দাড়ি ? সেটা কিভাবে বুঝলে ?
- সেটা সামনের ঐ আয়নায় দেখে । ওখানে আগে
একটা ছবি টাঙান ছিল।সাত দিন আগে উনি আয়নাটা ঝুলিয়েছেন। বললেন রমা দেবী ।
- কিন্তু অলোকদার চোখের সামনে তো তখন খবরের কাগজ ধরা ছিল ?
- দেখ না , কাগজটা সাত দিনের পুরন । আর তাতে ফুটো করা ।
যাঃ দিদি তুই না বড্ড অলোকদার পিছনে লাগিস । উনি কিন্তু
দরজা খোলার আগেই.বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি এসেছি।
-সেটা বারাণ্ডা থেকে বায়নাকুলার দিয়ে দেখে।
অলোক বাবু আর্তনাদ করে উঠলেন – যাঃ দিলে সব মাটি করে ?
- কিন্তু তুই এ সব জানলি কি করেরে ?
-পাওয়ার অফ অবসার্ভেশন। ক’দিন থেকেই তো দেখছি।
মানে গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরি?
-
-