Saturday, 14 November 2015

যোটক বিচার

           অষ্টকূট যোটক বিচার প্রসঙ্গে
.....................................................................।।
জ্যোতিষশাস্ত্রালোচনায় দেখা যায় যে খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দী পর্যন্ত বিবাহে নাড়ীনক্ষত্র কূট বিচার বা অষ্টকূট যোটক বিচার ছিলনা। (এই বিষয়ে শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় শ্রী হরিচরণ স্মৃতিতীর্থ বিদ্যারত্ন মহাশয় তাঁর বিবাহ-মিলন- বিষয়ক “ সুখের সন্ধান” পুস্তকে কিছু আলোচনা  করেছেন)।খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দী  থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন অবস্থায় ভারতীয় জনচিত্ত কর্ম বিমুখ ও ক্রিয়াশূন্য হয়ে পড়েছিল।সম্ভবতঃ ওই সময়ে অন্যান্য নানান রকম প্রবাদবাক্য ও  কুসংস্কারের সঙ্গে এই তথাকথিত বিবাহ মিলন বা যোটক বিচার পদ্ধতিটা জন মানসে অবস্য কর্তব্য হিসাবে প্রবেশ লাভ করে এবং কতিপয় সুচতুর ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এ যুগের ন্যায় সে যুগেও লোক ঠকান জ্যোতিষ ব্যবসা ফেঁদে বসেন ও সকল প্রকার সামাজিক ক্রিয়া কর্ম কে নিয়ন্ত্রন করার জন্য নানান রকম ফন্দী ফিকির, তাবিজ কবজ ও কুসংস্কারের আশ্রয় নেন।    
জন্ম সময়ের গ্রহসংস্থান থেকে মানুষের ভাগ্যফলের বিচারের তুলনায় নাড়ীনক্ষত্র ঘটিত অষ্টকূট বিবাহ মিলন বিচারের কোন যুক্তিসঙ্গত গুরুত্ব থাকে না।গণ-মিলনে-নর-রাক্ষস থেকে দম্পতির অকালমৃত্যুর কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি পাওয়া যায়না। কারন জন্মনক্ষত্রের উগ্র-চরাদি গণ থেকে নর-রাক্ষসাদির  প্রকৃতি বিচার করা হয়।এই গণনা ভাগ্যফলের বিচারের তুলনায়  স্থুল। কিন্তু লৌকিক বিচারে একটা আতঙ্কের কারন সৃষ্ট হয়ে বহুদিন ধরে চলে আসছে। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে পাত্রপাত্রীর পরস্পরের রাশির  মিলের অভাবে বড় জোর মনের বা মতের অনৈক্য ঘটতে পারে, কিন্তু দোষযুক্ত চন্দ্রে দম্পতির অমঙ্গলের কারন যুক্তিসঙ্গত ভাবে পাওয়া যায় না।কারন জ্যোতিষশাস্ত্র মতে চন্দ্র যুক্ত রাশি থেকে আয়ু এবং ভাগ্য বিচার করলে লগ্ন ভিত্তিক বিচারের কোন গুরুত্ব থাকে না।অথচ ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র প্রধানত লগ্ন ভিত্তিক গণনার উপরই নির্ভরশীল।
চন্দ্র সওয়া দুই দিন প্রত্যেক রাশিতে থাকে;পক্ষান্তরে লগ্ন প্রত্যেক দুই ঘণ্টা অন্তর পরিবর্তিত হয়।এই অবস্থায় চন্দ্র থেকে ভাগ্য গণনা এবং অকালমৃত্যু প্রভৃতি অমঙ্গল বিচার করলে, সওয়া দুই দিন পর্যন্ত যত পুরুষ বা স্ত্রীলোক জন্মাবে, তাদের একটা কুষ্ঠী দিয়ে যাবতীয় ভাগ্যফল ও স্ত্রী বা স্বামী হানির বিচার করা যাবে। তা কিন্তু কোনভাবেই সম্ভবপর নয়।
১০০২ খ্রীষ্টাব্দে  মালবের ধারা নগরীতে ভোজরাজের সভায় স্মৃতির পণ্ডিতগণ প্রথমে অষ্টকূট  বিচারের গণনা ‘রাজমার্তণ্ড’ নামক জ্যোতিষসংহিতায় প্রবর্তন করেন।তারপর আচার্যগণ ক্রমশঃ নক্ষত্রঘটিত যাবতীয় ফল বিবাহ-মিলনের বিচারে প্রবর্তন করেন।শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর ‘শুদ্ধিদীপিকা’, রামদৈবজ্ঞের ‘দৈবজ্ঞ- মনোহর ও ‘মুহূর্তচিন্তামণি’ প্রভৃতি পুস্তকে এবং খ্রীষ্টীয় ১৫শ শতাব্দীতে বঙ্গদেশের রঘুনন্দনের ‘জ্যোতিষতত্বে’ এই অষ্টকূট-বিচার স্থান পায়।এইভাবে ক্রমশঃ প্রসারলাভ করে পঞ্জিকার জ্যোতিষ বচনারথে স্থান পেয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
মানব জীবনের উপর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভাব সম্পর্কিত শাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র নামে পরিচিত। জ্যোতিষশাস্ত্রে মেষ, বৃষ, মিথুন, ইত্যাদি বারোটি রাশি, নয়টি গ্রহ, ও সাতাশটি নক্ষত্র এবং লগ্ন ভিত্তিক অসংখ্য যোগের ও সূত্রের সাহায্যে মানুষের ভূত ভবিষ্য বলার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।   
আশুন এবারে দেখা যাক যোটক বিচার বলতে ঠিক কি বুঝায়?
বিবাহের পূর্বে বর ও কন্যার পরস্পরের জন্মরাশি, জন্মনক্ষত্র ও রাশ্যাধিপ গ্রহদি থেকে, যে শুভাশুভ ফল বিচার করা যায়, তাকেই যোটক বিচার বলে। যোটক বিচার অষ্টপ্রকারে বিভক্ত।
বর্ণকূট, বশ্যকূট, তারাকূট, যোনিকূট, গ্রহমৈত্রীকূট, গণমৈত্রীকূট, ও ত্রিনাড়ীকূট। বর ও কন্যার পরস্পরের বর্ণের একতা বা মিত্রতা হলে এক গুন ফল, তার সঙ্গে বশ্যতা যোগ হলে দ্বিগুণ ফল, তারাশুদ্ধি যোগে ত্রিগুন ফল, এইভাবে অষ্টপ্রকারে শুভ হলে  দম্পতীর পূর্ণ শুভ ফল ভাবা হয়।
এবার দেখা যাক বর্ণ কাকে বলে বা বর্ণ বলতে ঠিক কি বুঝায়-। জ্যোতিষশাস্ত্রে মেষ, বৃষ, মিথুন, ইত্যাদি যে বারোটি রাশি ব্যাবহার করা হয় তাদের বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র বর্ণে  বিভক্ত করা হয়েছে।যথা যে ব্যক্তিগনের জন্ম কর্কট, মীন, বা বৃশ্চিক রাশিতে তাঁদের বর্ণ বিপ্র। এইভাবে যাঁদের জন্ম সিংহ, তুলা বা ধনু রাশিতে তাঁদের বর্ণ ক্ষত্রিয়। যোটক বিচারের নিয়মে শুদ্র বর্ণের থেকে বৈশ্য বর্ণ শ্রেষ্ঠ, বৈশ্য বর্ণের থেকে ক্ষত্রিয় বর্ণ শ্রেষ্ঠ, আবার ক্ষত্রিয় বর্ণের থেকে বিপ্র বর্ণ শ্রেষ্ঠ।
বর্ণ ফলমে বলা হয়েছে যে-
"ক্ষাত্র-বিট্-শুদ্র-বিপ্রাঃ স্যুঃ ক্রমান্মেষাদি-রাশয়ঃ।
তত্র বর্ণাধিকা কন্যা নৈবোদ্বাহ্যা কদাচন" ।।
অর্থাবরের বর্ণাপেক্ষা কন্যার বর্ণ শ্রেষ্ঠ হলে, সেই কন্যাকে কদাচ বিবাহ করিবেনা”। করলে কি হবে?
"বর্ণশ্রেষ্ঠা তু যা নারী বর্ণহীনস্তু যাঃ পুমান।
বিবাহং যদি কুরব্বীত তস্য ভর্তা বিনশ্যতি"।।
অর্থা “বর্ণশ্রেষ্ঠা কন্যাকে বিবাহ করিলে ভর্তার নিধনাশঙ্কা।
সেই কন্যা অতি মহকুল সম্ভূতা হইলেও পতিপরায়ণা হয় না”।
একে তো জন্ম চান্দ্র রাশিকে উপরিউক্ত চারটি গণে বিভাজন বিজ্ঞান না হোক প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্র সম্মতও নয়, তার উপর শুধু মাত্র গণে না মিলিয়ে বিয়ে দিলে, পুরুষের নিধনাশঙ্কা। এমন কথা কেবল মাত্র অবৈজ্ঞানিক এবং অবাস্তবই নয় হাস্যসকর ও বটে।  
বশ্যকূট্। “মিথুন, কন্যা, তুলা, কুম্ভ, ও ধনুর পূর্বা্রদ্ধ, যদি বরের রাশি হয় এবং মেষ, বৃষ, কর্কট, ইত্যাদি যদি কন্যার রাশি হয় সেই কন্যা বরের বশীভূত হয়”।
এই ভাবে কয়েকটি জন্ম চান্দ্র রাশিকে অন্য কয়েকটি জন্ম চান্দ্র রাশির বশ্য ধরা হয়ে্ছে। এবং বিপরীতে বিপরীত ফল বলা হয়েছে।
"এবং বশ্যসমাযোগে দম্পত্যোঃ প্রীতিরূত্তমা।
বশ্যাভাবেহপি দম্পত্যো্রবিবাহঃ কলহ-প্রদঃ"।।
অর্থাকথিত নিয়মে বর ও কন্যার রাশির বশ্যাবশ্য বিচারে যদি কন্যা বরের বশ্যা হয়, তবে শুভ ও পরস্পর প্রীতিলাভ হইয়া থাকে ; অন্যথায় কলহাদি হইয়া থাকে”।।
পৃথিবীকে ঘিরে চন্দ্র তার পরিক্রমায়, বারটি রাশির এক একটিতে সোয়া দু দিন অবস্থান করে। ঐ সময়ে যত লক্ষ্য মানুষ জন্মায় তাদের সকলেরই ঐ একই জন্মরাশি হয়। অথচ কোন এক রাশিতে জন্মান মানুষ অন্য আরেক দিনে জন্মান মানুষের বশ্য হবে। এবং বিবাহের পরও সেই হিসাবে বশ্যতা চলতে থাকবে ধরে নিয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।আবার কন্যা  দিগকে বরের বশ্য হতেই হবে। অন্যথায় অনর্থ হবে।
মধ্যযুগীয় পুরুষ শাসিত সমাজের সমাজপতি গণের নিকট এর থেকে ভাল বিধান আর কীই বা আশা করা যায়?
কিন্তু পরম আশ্চর্যের ও পরিতাপের বিষয়, বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও বহু শিক্ষিত মানুষ এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন এবং এই সব তথাকথিত জ্যোতিষিক বচনের উপর নির্ভর করে নিজেদের সন্তান সন্ততি গণের বিবাহ স্থির করেন।
এবারে আসা যাক গণ কূটের কথায়। গন কূট কি? অমুকের অমুক গণ, দেব, নর না রাক্ষস? কি ভাবে জানা যাবে?
জ্যোতিষ গণনায় যে সাতাশটি নক্ষত্রকে ধরা হয়েছে, তাদেরই ঐ তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বর ও কন্যার জন্মনক্ষত্র থেকে গণ কূট বিচার করতে হয়।
স্বাতী, হস্তা, অনুরাধা, অশ্বিনী, ইত্যাদি নয়টি সত্ত্ব গুন বিশিষ্ট নক্ষত্রে বা জন্মকালীন চন্দ্রাশ্রিত নক্ষত্রে জন্মিলে দেবগন ও সত্ত্ব গুণী হয়। পূর্বফল্গুনী, পূর্বাষাড়া, পূর্বভাদ্রপদ, ইত্যাদি নয়টি নক্ষত্রে বা জন্মকালীন চন্দ্রাশ্রিত নক্ষত্রে জন্মিলে নর গন হয়।
জ্যেষ্ঠা, মূলা, মঘা, ইত্যাদি নয়টি নক্ষত্রে বা জন্মকালীন চন্দ্রাশ্রিত নক্ষত্রে জন্মিলে রাক্ষস গণ হয়।এতো হল গণের পরিচয়। এবারে বিচারটা কিভাবে হবে?
“স্বজাতৌ পরমা প্রীতিরমধ্যা দেব-মানুষে।
দেবাসুরে বৈরতা চ ম্রিত্যুরমানুষ-রাক্ষসে।।
রাক্ষসী চ যদা কন্যা মানুশ্চ বরো ভবেত।
তদা ম্রিত্যুরন দূরস্থো নির্ধনত্বমথাপি যা” ।।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে মানুষের শিক্ষা দীক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি,  জাতিগত বা বংশগত ভাবধারার কোন মূল্য নেই। স্বাতী, হস্তা, অনুরাধা, অশ্বিনী, ইত্যাদি নক্ষত্রে জন্মালেই তার মধ্যে সত্ত্বগুণ থাকবে এবং সে দেবতুল্য মানুষ হবে। একই ভাবে জ্যেষ্ঠা, মূলা, মঘা, ইত্যাদি  নক্ষত্রে জন্মালে, সেই কন্যা যতই সুশীলা হোকনা কেন, বিনা দোষে তার রাক্ষস গণ হবে।এবং তার মধ্যে তমমগুণ  থাকায় দেবগণের পাত্রের সঙ্গে তার কোন মতেই বিবাহ করা চলবে না। বিয়ে হলে কি হবে? ভাল হবেনা। কলহাদি অশান্তি হবে। আর নর- রাক্ষসের বিবাহে কি হবে?
“অসুর- মনুজয়োশ্চেন্মৃত্যুমেব প্রদিষটা"।।
নরগণের পাত্রের সঙ্গে রাক্ষস গণের কন্যার বিবাহ হলে পাত্রের মৃত্যু হবে। অরথা রাক্ষসী কন্যা নর পাত্রকে খেয়ে ফেলবে।  
শিক্ষিত মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে এটা কিভাবে ভাবতে পারে?
কুসংস্কারেরও কথাও একটা সীমা থাকা উচিৎ। বিনা কারনে শুধু  মাত্র কুসংস্কারের বশে প্রতিদিন কতো ভাল ভাল বিবাহের যোগ নষ্ট হচ্ছে। কথায় বলে- “পুরুষের ভাগ্যে জন ও নারীভাগ্যে   ধন”।তাই অনেক পাত্র পক্ষ আবার সুলক্ষণা ভাগ্যবতী পত্রীর খোঁজ করেন যাতে সেই পত্রীর ভাগ্যযোগে তার স্বামীর আর্থিক ও বৈষয়িক উন্নতি হয়। কিন্তু জ্যোতিষের দৃষ্টিতে এই সকল চিন্তা, এমনকি তাবিজ কবজ, গ্রহরত্নাদি ধারন করে ভাগ্য ফেরানর চেষ্টা ও অধিকাংশই অন্তঃসারশুন্য। পণ্ডিত বরাহ  বলেছেন যে “ মানব স্ব স্ব কর্মানুসারে সুখদুঃখ ফল ভোগ করিয়া থাকে। হিন্দু ষড়দর্শন ও বলে যে, ভাগ্য অর্থে মানবের কর্মফলভোগ বুঝায়।মানুষ যে সকল ভালোমন্দ কর্ম করিয়া থাকে তাহার ফলভোগ, এই জন্মে বা পরজন্মেই হউক, তাহাকে  ভোগ করিতেই হইবে”। এই দুই শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, কারো ভালমন্দ কর্মফল ভোগের জন্যে অন্য কেউ দায়ী হতে পারে না।ফলে যে যার কর্মফল ভোগ করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে একই শাস্ত্রের দু দল পণ্ডিতের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত ছিল।এ বিষয়ে নিরপেক্ষ ভাবে কিছু বলতে গেলে, বলা যায় যে ভাগ্য বলে সত্যই যদি কিছু থেকে থাকে তা অমোঘ। তাকে কেবল মাত্র বিবাহের দ্বারা বদলান যায় না।এবং এই ধরনের চেষ্টা শুধু মাত্র অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কার পূরণই নয় সমাজের পক্ষে ক্ষতিকরও বটে।  

তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪/১১/২০১৫
(লেখকের লেখা-ভৌম দোষ/ ছিন্ন মূল/  ভিক্ষা / এঁড়ে তক্ক / মোহর/বুদ্ধি পড়ুন ও comments এ  মতামত জানালে বাধিত থাকব )  
         
       
           

                  

Saturday, 7 November 2015

বুদ্ধি

               বুদ্ধি

 অনেক বছর আগে বাঙালীর যে সময় সুদিন ছিল, তখন ভারতের   প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণ প্রায় সকলেই  ছিলেন বাঙালীসেই  সময় এক দিন সন্ধ্যায়  একজন মধ্যবিত্ত বাঙালী, রায় বাবু হাওড়া  থেকে দিল্লী গামী একটা রেলের ইন্টার  ক্লাস কামরায় চাপলেন। তখনকার দিনে মানুষ এখনকার মতো এতো হুট হাট হিল্লি দিল্লী করে বেড়াত না।ফলে কামরাটা একরকম ফাঁকাই  ছিল। বাঙালী ভদ্রলোকের সঙ্গে সেই  কামরায় উঠলেন একজন অবাঙালী ভদ্রলোক, মিঃসিংতিনি দিল্লী যাচ্ছেনট্রেন ছাড়ার কিছু পরে, রাত্রে  শুয়ে  পড়ার  আগে, দুজনে যে যার টিফিন বাক্স খুলে খাবার সাজিয়ে খেতে বসলেন। মিঃ সিং  বের  করলেন খাঁটি ঘীয়ে ভাজা পরোটা আর কষা মাংস। সঙ্গে রায়তা আর  স্যালারড।রায় বাবু বের করলেন বাঙলা খাবার ডাল ভাত লাউচিংড়ী আর পুঁটী মাছ ভাজা।কিন্তু মিঃ সিং এর খাবারের গন্ধে রায় বাবু  জিভে জল এসে গেল। দুজনে মুখোমুখি বসে খাওয়া শুরু করতে যাবেন, এমন সময় মিঃ সিং বলে বসলেন- “দাদা একঠো বাত পুঁছু?  আপ লোগ মেহনকরতা , হাম লোগ ভী মেহনকরতা হ্যায়।মগর আপ লোগ জিতনা উপর পৌঁচতাহাম লোগোঁ সে উও কিঁউ নেহি হোতা” ?  রায় বাবু  গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন-“ তুম লোগকা বুদ্ধি কম হ্যায় ইসিলিয়ে”। মিঃ সিং অবাক হয়ে জানতে চাইলেন-“ বুদ্ধি ক্যায়া হোতা হ্যায় ?আউর কাঁহা পর মিলতা”?   
 রায় বাবু পুঁটী মাছ  দেখিয়ে বললেন- “হিয়া। এই মছলি খানে সে সেই  বুদ্ধি হোতা”। মিঃ সিং  ভক্তিতে গদগদ হয়ে হাত জোড় করে বললে-“দাদা আপকা ইয়ে বুদ্ধিওয়ালা খানা হামকো দিজিয়ে, আউর   হামারা খানা আপ  লিজিয়ে”।প্রস্তাবটা শুনে রায় বাবু  আনন্দ হলেও  গম্ভীরসে বললেন-“নেহী নেহী উহ ক্যাসে হোগা? হামারা বুদ্ধি কম হো  যায়গা না”? –“ আরে আপ তো বচপন সে ইয়ে বুদ্ধি খাতা হ্যায়, এক দিন নেহি খানেসে কুছ কম নেহি হোগা”।রায় বাবু  নিমরাজি ভাব দেখিয়ে নিজের খাবারটা তাকে দিয়ে দিল। আর তার খাবার টা নিয়ে তরিবৎ করে খেল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিঃ সিং এর মনে হো্ল, কাল রাত্রে এই  বাঙালী লোকটা কি সব বুদ্ধি সুদ্ধির নাম করে তাকে একটা অখাদ্য খাবার খাইয়ে তার ভাল খাবারটা খেয়ে নিয়ে খুব ঠকিয়েছেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে-“দাদা ইয়ে কাম মগর আপ আচ্ছা নাহি কিয়া”।
-“ কোন সা কাম”? জানতে চাইল রায় বাবু।
-“ইএই যো আপ কাল ক্যায়া সব বুদ্ধি সুদ্ধি বোলকে হামারা আচ্ছা কিমতি বালা খানা খা লিয়া, অউর হামকো পুঁটী মাছ খিলায়া”।  
রায় বাবু গম্ভীর ভাবে বললেন যে “ ইয়ে বুদ্ধি কাল তুমারা কাঁহা থা? অউর আভী আজ কাঁহাসে আয়া”?


তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 
(ভিক্ষা / এঁড়ে তক্ক/ মোহর পড়ুন)