Wednesday, 2 December 2015

             বসন্তের কোকিল
সকালে ঘুম থেকে উঠে বেচারাম মণ্ডলের (আসল নাম নয়), প্রথম কাজ হল আজকের খরচ চালানর মতো টাকা জোগাড় করা।বাবা মারা যাওয়া ইস্তক এটাই তার দৈনিক প্রধান কাজ।কিন্তু মুশকিল হল যে আগেকার মতো আজকাল আর ধার দেনা টেনা  তেমন পাওয়া যায়না। মানে কেউ আর দেয় টেয় না। তার উপর  বাড়ীতেও তেমন বিক্রি করার মতো  ভাল জিনিষ পত্র কিছু আর  বিশেষ অবশিষ্ট নেই।আজকাল সকাল  বিকেলটা তার মুড়ি চিবিয়েই কাটে, তাই থালা বাসন গুলো সে আগেই বিক্রি করে দিয়েছে।বাকী ছিল হাঁড়ী কড়াই গুলো, সেগুলোও মায় এমনকি উনুনটা ক’দিন আগে বিক্রি হয়ে গেছে অথচ তাদের কিন্তু একদিন অবস্থা ভালই ছিল। তার বাবা কেনারাম  মণ্ডল(আসল নাম নয়), তেজারতি ব্যবসা করে অগাধ বিষয় সম্পত্তি করে ছিলেন। তাঁর সময়ে গাঁয়ে ইস্কুল না থাকায় তিনি পাঠশালার বেশি পড়তে পারেননি।কিন্তু সেই সামান্য বিদ্যে নিয়ে বুদ্ধির জোরে ব্যবসা চালিয়ে তিনি অগাধ বিষয় সম্পত্তি করেছিলেন।পরে গাঁয়ে ইস্কুল হওয়ায় তিনি বেচারামকে সেখানে ভর্তি করে দিয়ে নিশ্চিন্তে  ছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেটি তাঁর বিদ্বান হবে। অথচ ছেলে যে তার শুধু মিড ডে মিলের লোভেই ইস্কুলে যায়, আর ইস্কুলের মাস্টাররাও সেখানে সারাদিন শুধু সে সব নিয়েই ব্যস্ত থাকে, খবর তাঁর জানা ছিল না।এদিকে পাস ফেল না থাকায়, ছেলে বছরের পর বছর ক্লাসে উঠে গেছে এবং যথা সময়ে প্রাকৃতিক নিয়মে ও হল কালেকশনের জোরে সে মাধ্যমিকটাও পাস করে ফেলেছে। এদিকে নিজের নাম ও  শুদ্ধ করে লিখতে পারেনা।সাধারন যোগ বিয়োগ করতে পারেনা মা তো তার আগেই মারা গিয়ে ছিলেন, এবার ক’দিনের জ্বরে হঠা বাবা মারা যেতে সে বেচারা অকূল পাথারে পড়ল হিসেব নিকেশ না বোঝায় ক’দিনের মধ্যেই তার ব্যবসা লাটে উঠল। ইয়ার বক্সির দল তাকে সাহায্য করার নামে খারাপ রাস্তায় নিয়ে গিয়ে, বদ অভ্যাস ধরিয়ে ঠকিয়ে সর্বস্বান্ত করে দিল। হাজার হোক সে একজন দস্তুর মতো লেখা পড়া জানা? মাধ্যমিক পাশ ছেলে তো বটে, কি করে আর লাঙ্গোল ঠেলে? কি করেই বা সে কোদাল কোপায়? চাকরির চেষ্টা যে সে করেনি তা নয়, তবে কেউ তাকে রাখেনি। এদিকে দিন দিন তার অবস্থা পড়ে যাচ্ছে। এতদিন তবু যাহোক করে চলছিল, আজ আর ঘরে বেচার মতো কিছুই নেই। সেই শ্রাবণ মাস যেতেই সে তার ছাতাটা বেচে দিয়ে ছিল।আর তারপর থেকে সে অপেক্ষা করে আছে যে কবে শীতটা যাবে? তখন সে তার শালটা বেচবে।এদিকে শালা শীতের যাবার কোন নামই নেই।হ ঠা সে শুনল। স্বকর্ণে পরিষ্কার শুনল। এবং একবার দুবার নয় পর পর বেশ কয়েক বার শুনল সুমিষ্ট মনোমুগ্ধকর কুহু  কুহু ডাক।এ ডাক ভুল হবার নয়।এ পরিষ্কার কোকিলের ডাক।সুতরাং “বসন্ত এসে গেছে”।জীবনে এত আনন্দ আগে সে কোনদিন পায়নি। এত জোরে লাফিয়ে উঠল যে আর একটু হলে মাথাটা ঘরের ছাদে ঠুকে যেত। দৌড়ে গিয়ে ক্যালেন্ডার দেখল, ঠিক, যা ভেবেছে তাই ঠিক।আজ পয়লা ফাগুন। অর্থাশীত কাল চলে গেছে। এবার নিশ্চিন্তে শালার শালটাকে  বেচে, অনেক দিন  পরে য়ার বক্সিদের নিয়ে  আশ  মিটিয়ে খানাপিনা করতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগানর সময় সে একটু ভাবল, “তালাটা লাগানর কোন দরকার আছে কি? মানে চুরি যাবার মতো কিছুই তো আর অবশিষ্ট নেই। যাকে কথায় বলে “ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়”। তবু  লাগানই  থাক। বলা তো  যায় না শেষে  তালাটাই যদি চুরি যায়”? ভবিষ্যতে  সেটাও তো একদিন বেচতে  হবে। শালটা বেচে যা পাবে বলে ভেবেছিল, পেল তার থেকে অনেক কম। তবু খানাপিনা ভালই হল। কিন্তু  রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় শ্ত্রুর মুখে  ছাই দিয়ে অসময়ে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। আর তার হাত ধরাধরি করে জাঁকিয়ে  পড়ল ঠাণ্ডা। বাড়ির কাছাকাছি আসতে কি যেন একটা  তার পায়ে ঠেকল। নীচু হয়ে দেখল যে সেই কোকিলের ছানাটা মরে পড়ে  আছে।  
ভিজে শরীরে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একটা দুঃখের হাসি হেসে সে বললে  -  “ ভাই কোকিল তুমি নিজে মরলে সঙ্গে আমাকেও মারলে”। 


তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

২৭/১১/২০১৫                                            


No comments:

Post a Comment