Sunday, 10 January 2016

গৃহত্যাগ

                        গৃহত্যাগ
……………………………………………………………………………………………………..
বাংলা দেশের হুগলী জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের শিশু কানাই।বাবা দূর বিদেশে কোথায় যেন চাকরী করেন। মাসে কয়েক দিনের জন্যে আসেন, কোন কোন মাসে আসেনও  না।গাঁয়ে কোন পাঠশালা বা ইশকুল নেই।ছোট্ট কানাই পড়াশুনো শেখে আর গল্প শোনে তার মায়ের কোলে বসে।মাটির বাড়ির রান্না ঘরের দাওয়ায় বসে, মা ছেলেকে নানান রূপ কথা আর রামায়ন মহাভারতের সঙ্গে সঙ্গে মহাপুরুষদের  জীবনী ও শোনাএমনি ভাবে একেবারে ছোটবেলাতেই ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের নামও কানাই শুনে  ছিল তার মায়ের মুখেতারপর যখন তার বয়স মাত্র আট বছর, মায়ের কাছে সে বায়না ধরে রামকৃষ্ণ দেবের পবিত্র জন্ম ভূমি কামার পুকুর জয়রামবাটি যাবে বলে। মা বলেন “বেশ তো বাবা বাড়ি আসুক, তারপর বাবার সঙ্গে যাস”কানাই কিন্তু শোনার পাত্র নয়। তার এক কথা,বাবার সঙ্গে নয়, সে একাই যাবে। এবং এক্ষুনি যাবে। ছেলেকে মা ভালই চিনতেন। এবং খুব ভাল করেই জানতেন যে তাকে নিরস্ত করা যাবে না। অগত্যা কি আর করেন, কানাই কে একাই যেতে দেন।লক্ষ্মী পুর থেকে কামার পুকুরের দূরত্ব মাত্র পাঁচ মাইল হলে কি হয়? সেকালে পথঘাট না থাকায় বালক কানাই কে একা মাঠের পর মাঠ পার হয়ে যেতে হয়। আশ্বিন মাসের মেঘ হীন উন্মুক্ত অসীম আকাশ, তার নীচে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের খেত, কাশের বনে ঢেউ তুলছে এলোমেলো হাল্কা হাওয়া।আকাশের বুকে ছবি এঁকে উড়ে যাচ্ছে সাদা বকের সারি।ধরিত্রীর এই অপরূপ অপার্থিব অনির্বচনীয় নৈসর্গিক শোভার  মাঝে একাকী সে নিঃসঙ্গ এক বালক তার মনে হল বন্ধন হীন মুক্ত বিহঙ্গের মতো সেও এদের মাঝে বিলীন হয়ে যায় যদিও সে দিন সে বালক কিন্তু জানত না যে একাকীত্বের এই ঐশ্বরিক অনুভূতি বারবার তাকে ঘর থেকে ডেকে  পথে নামাবে। গৃহত্যাগের প্রবল বাসনাটি সেই দিনই তার মনে প্রথম অঙ্কুরিত হয়কামার পুকুর থেকে ফিরে বালক কানাই এক দিনেই যেন সাবালক হয়ে গেল।
সব সময় অন্যমনস্ক ভাবে কি যেন ভাবে মা নির্মলা দেবী তার হাবভাবে বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভাল লাগল না তাঁরএ যেন বিবাগী হবার আগের লক্ষণ।স্বামী হরিপদ মুখোপাধ্যায় বাড়ি ফিরতেই তিনি বললেন “কানাই কে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে কোন ইস্কুলে ভর্তি করে দাও দিন দিন ও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে” দশ বছর বয়সে কানাই তার পিতার হাত ধরে তাঁর কর্ম ক্ষেত্র সুদূর দক্ষিণে  সুন্দর বন সংলগ্ন ভাঙড় গ্রামের দিকে পড়ি দিলেনএবং সেখানকার ইস্কুলে ভর্তি হলেন।তারপর  মাত্র পনের বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ভবানীপুর মিত্র ইন্সটিটিউট থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সংস্কৃতে দুটি লেটার সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে, আই এস সি কোর্সে তিনি আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন ।এই সময়  থেকে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি আকর্ষিত হন এই আই এস সি পড়ার সময়েই একবার দক্ষিণেশ্বরে  গিয়ে রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে অভিভূত হয়ে ছোট বেলার সেই গৃহত্যাগের বাসনাটা তাঁকে আবার পেয়ে বসে। সেই স্থান থেকে তিনি শ্রীমদ্ভগবত গীতা এবং ঠাকুরের কথামৃত বই দুটি নিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি।সাধু হবার ইচ্ছে নিয়ে তিনি ট্রেনে চেপে সোজা হরিদ্বারে গিয়ে হাজির হন। হরিদ্বারে পৌঁছুন মাত্র প্রথম দিনেই একটা উল্লেখ যোগ্য ঘটনা ঘটল। উনি যখন নীলধারার পাশে বসে ছোট ছোট পাথরের টুকরো জলে ছুঁড়ছিলেন, এক সাধু মহাত্মা এসে তাঁকে বললেন “ছি ছি বাবা, মাকে কি এমন করে পাথর ছুঁড়ে মারতে হয়? সেই সাধুর মা গঙ্গার প্রতি এমন অভিব্যক্তি, একেবারে মা- সন্তানের মতন; শুনে তিনি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়েন।এরপর তিনি যান ভারত সেবাশ্রমে।সেখানে এক যোগী সাধু তাঁকে বলেন- “বাছা তুমি বড় অল্প বয়সে গৃহত্যাগ করেছ, এতে লাভ হবেনা।বাড়ি গিয়ে ভালভাবে জীবন যাপন করোআর বড় হয়ে সাধু সঙ্গ কোরো”।এই ত্রিকাল দর্শী মহাপুরুষ হয়ত যোগ বলে বুঝে ছিলেন যে কানাই লাল সাধারন মানুষ নন ইনি শুকনো ফকির হয়ে তীর্থে তীর্থে ভিক্ষা করে বেড়ানর জন্য বা শুধু মাত্র সাধন ভজন ও হোম যজ্ঞাদি আধ্যাত্মিক ক্রিয়া কলাপের দ্বারা অপার ঐশ্বরিক আনন্দ লাভের জন্য জন্মাননি।বরং তার থেকেও বেশী, বাস্তব জীবনে কর্মের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করে, সেই জ্ঞানের আলোকে ভুবনকে উদ্ভাসিত করতে ও নিত্য নূতন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে, যন্ত্রণায় ক্রন্দনরত শিশুর মুখে হাসি ফোটাতেই  তিনি এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেশ কে তথা পৃথিবী কে কিছু দিয়ে যাবার জন্যে জ্ঞান তাপস সাধক বিজ্ঞানী কানাই লাল, ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে হুগলী জেলার অন্তর্গত আরামবাগ মহকুমায় লক্ষ্মীপুরে জন্মে ছিলেনবড় হয়ে গুরু লাভের উদ্দেশ্যে বহুবার তিনি বহু সাধু সঙ্গ করেছেন। অনেক কিছু শিখেওছেন, কিন্তু সদগুরুর দর্শন পাননি। এবং কেউ তাঁকে ঈশ্বর দর্শন করাতেও পারেনি সে যাইহোক বিফল মনোরথ হয়ে সেখান থেকে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে পড়াশুনোয় মন দিলেন এবং ১৯৪১ সালে আই এস সি পাশ করে আর জি কর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ডাক্তারি পড়তেএই সময় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও অনাড়ম্বর জীবন যাত্রায় অনুপ্রানিত হয়ে তিনি দেশ সেবা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।এও এক ধরনের anti establishment এর চিন্তা, যা গৃহত্যাগেরই নামান্তর। ফলে ক্লাস চলা সত্বেও তিনি কোন ক্লাস attend করতে পারতেন না।আর ঠিক তখনই বহু সামাজিক কাজকর্ম করার সুযোগ এসে যায়। চরকায় সুতো কাটা, নাইট স্কুল চালান, বস্তী উন্নয়ন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন।এতদসত্বেও ১৯৪৬ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে এম বি বি এস পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর লেক মেডিক্যাল কলেজে চার বছর শিক্ষানবিশি করেন।পরে ট্রপিক্যাল স্কুলে রিসার্চ স্কিম নিয়ে যোগ দেন।কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫১ সনে পি এইচ ডি করেন।ডঃ কানাইলাল মুখপাধ্যায়ই প্রথম ব্যক্তি যিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Medical Chemistry তে পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন।এরপর ১৯৬২ সালে আমেরিকার Winconsin University থেকে Dr of Philosophy (PHD)  করেন।জীবনের সমস্ত পরীক্ষাতেই বরাবর তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।১৯৫৮ সাল থেকে কর্ম সূত্রে আমেরিকায় বসবাস করার পর সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে, দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৬২ সালে দেশে ফিরে আসেন। 
প্রফেসর মুখোপাধ্যায়ের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পঠন পাঠন, সাধন ভজন, ভ্রমণ, ও নিঃস্বার্থ   পরোপকার। জীবনের একেবারে শেষ কটি বছর সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি নিয়ম করে  রোজ দুবেলা সুবোধ বালকটির মতো পড়াশুন করতেন।আর একবার তিনি যা পড়তেন, জীবনে কোন দিন তা ভুলতেন না।তিনি তাঁর অসাধারণ মেধা ও স্মৃতি শক্তির পরিচয় জীবনের একেবারে শেষ দিন একানব্বুই বছর বয়স পর্যন্ত দিয়ে গেছেন। একবার তাঁর কলিকাতার বেহালাস্থ পৈত্রিক বাস ভবনের নিকটবর্তী একজন প্রতিবেশী তাঁকে প্রশ্ন করেন “ আচ্ছা ডাক্তার বাবু আপনি তো শুধু মাত্র একজন ডাক্তারই নন তাদের শিক্ষক, তার সঙ্গে আবার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানীও বটে, তা  এই বৈজ্ঞানিক ক্রিয়া কান্ডের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা কে বা জাগতিক জ্ঞানের সঙ্গে বহির্জাগতিক অনুভূতিকে মেলালেন কি ভাবে”? উনি সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিলেন-“এর অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি উপনিষদ থেকে”।সত্যি, যজ্ঞোপবীত ও শিখা ধরি যে পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও সাত্ত্বিক মানুষটির দিন  শুরু হ’ত ভোর চারটের সময় ঠাকুর ঘর পরিষ্কার ও পূজা পাঠ দিয়ে, যিনি পুজা সম্পূর্ণ না করে জলস্পর্শ করতেন না, তাঁকেই আবার দেখা যেত সকাল দশটার সময় ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে ফিটাস বা ভ্রুন নিয়ে কাটাকুটি করে গবেষণা করতে।হ্যাঁ, ১৯৬২ সালে আমেরিকার উন্নত মানের জীবনযাত্রা, ভোগবিলাস, ভাল চাকুরীর আর্থিক প্রলভনাদি ত্যাগ করে দেশে ফিরে তিনি ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে prof of Bio Chemistry পদে যোগ দেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও কর্মনিষ্ঠায়  সেই সময়ে ইন্সটিটিউটে ভর্তি  রুগী ও তাদের পরিবারের লোকজনেরা ডঃ মুখারজীর ও সেখানকার অন্যান্য স্টাফে দের আন্তরিক ব্যাভহারে আপ্লূত হয়ে পড়তেন। দীর্ঘ বারো বছর ওখানে কাজ করার পর শ্রদ্ধেয় মন্ত্রী শ্রী অজিত কুমার পাঁজা মহাশয়ের অনুরধে গবেষণার কাজ আরও উন্নত মানের করার জন্যে তিনি ইন্সটিটিউটের চাকরী ছেড়ে এস এস কে এম হসপিটালে Institute of post graduate medical Education and Research য়ে যোগ দেন। সাত বছর সেখানে কাজ করার পর তিনি আবার ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে ফিরে আসেন। এরপর রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে Honorary professor পদে বহুকাল কাটান। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ছাত্র ছাত্রী গনকে তিনি গবেষণায় সাহায্য করতেন। ভারতবর্ষের ও পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভিসিটিং লেকচারার হিসাবে কাজ করেছিলেন।ভাবা যায়, যে বিজ্ঞানীর পেপার  পৃথিবীর বিভিন্ন সায়েন্স জার্নালে ১৯৫১ সাল থেকে সমাদৃত হয়ে আসছে, তিনি  ভারত সরকারের  কাছে চির উপেক্ষিত থেকে গেছেন? এমন কি, ১৯৮১ সালে World health organization (W.H.O) এর ডিরেক্টর ডঃ ক্যাসেল কুপফার যখন তাঁকে কনসাল্টেন্ট বায়োকেমিস্ট হিসাবে কাজ করার জন্য ডাকেন, তখন ও সরকারের তরফ থেকে কোন সাহায্য তো করা হয়ইনি উল্টে স্বাস্থ্য দফতরের ছাড় পত্রের জন্য তাঁকে ঘোরা ঘুরি করতে হয়। ডঃ মুখারজীর অভিধানে তাঁবেদারি, চাটুকারিতা ইত্যাদি শব্দ গুলি না থাকায় তিনি কোন দিনই তাঁর যোগ্যতার কোন সরকারি স্বীকৃতি পাননি। তবে তার জন্য কোন দিনই তিনি লালায়িত ছিলেন না। বরং সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি একটা গবেষণাগার তৈরি করেন যার নাম মহাত্মা গান্ধী ল্যাবরেটরি ফর ক্লিনিক্যাল ডায়গনসটিক এন্ড রিসার্চ। গবেষণায় ইচ্ছুক যে কেউ সেখানে গিয়ে ওনার সাহায্য পেতে পারতেন।ডঃ কানাইলাল মুখোপাধ্যায় জীবনের পথ হেঁটে ছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণের লোক শিক্ষা, স্বামী বিবেকানন্দের কর্ম যোগ ও মহাত্মা গান্ধীর অনাড়ম্বর জীবন যাত্রায় অনুপ্রানিত হয়ে। গবেষণা, শিক্ষকতা, আধ্যাত্মিক চর্চা ও ভ্রমন এগুলোই ছিল ওনার জীবনের মূল মন্ত্রএবং পরম নিষ্ঠার সঙ্গেই এগুলি তিনি পালন করতেন।এর মধ্যে কোথাও কোন ফাঁকিবাজি ধান্দাবাজি বা লোক দেখান ভণ্ডামি ছিলনা।   
তবু এ সবের মধ্যে থেকেও গৃহত্যাগের বাসনাটা কিন্তু ওনার মনে সব সময়ই সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ   করত।তাই মাঝে মাঝেই কাজের ফাঁকে হিমালয়ের পথে রওনা হয়ে যেতেন। কখনও যেতেন দল বেঁধে তীর্থ করতে, কখনও বা আবার একা একাই যেতেন ট্র্যেকিং করে গ্লেসিয়ার দেখতে।একটা মজার কথা,  তীর্থ যাত্রা কালে বা উদ্দেশ্য হীন ভাবে হিমালয়ের বুকে ঘুরে বেড়ানর সময়ও ওনার খদ্দরের ঝুলিতে থাকত ছাত্র ছাত্রী গণের গবেষণার কাগজ পত্র বা থিসিসের পাণ্ডুলিপি।ভ্রমণ কালেও সময় পেলেই সেগুলি উনি দেখতেন এবং প্রয়োজন মতো সংশোধন করে দিতেন। ১৯৭৩ সালে একবার তিনি সদলবলে অমরনাথ যাত্রা করেছিলেন।সেই যাত্রা পথেই একজন ছাত্রের থিসিস শেষ করেছিলেন।এ বিষয়ে তিনি তাঁর ছাত্রগনের উদ্দেশ্যে চিঠিতে লেখেন-“ ১১ তারিখে গোপালের thesis complete হয়ে গেল।এবার অমরনাথ যাত্রা গোপালের পক্ষেই শুভঙ্করী।জম্মুতে প্রবল বৃষ্টি না হলে কাশ্মীরের পথও বন্ধ হ’ত না, গোপালের thesis ও শেষ হ’ত না।সুতরাং গোপালকে বলবে অমরনাথটার জন্যে  special ভোগ চড়াতে”। সুতরাং এ বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে তিনি বিজন বনপথে বা পর্বতের সানুদেশে বা অধিত্যকায় একা বসে একটি গুরুগম্ভীর বৈজ্ঞানিক বিষয়ের উপর লেখা thesis দেখতে পারতেন। আর অমন গভীর ভাবে চিন্তা করতেও খুব কম মানুষকেই দেখ গেছেতিনি যখন পড়াশুনোর মধ্যে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে ডুবে যেতেন, তাঁকে দেখে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ দেবের কথা মনে পড়ে যেত।তাঁর কন্যাসমা সর্বক্ষণের সঙ্গিনী তথা মন্ত্র শিষ্যা চামেলী গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে তীর্থ যাত্রা  প্রসঙ্গে তিনি লিখে ছিলেন-“অমরনাথে পৌঁছিয়ে পুজা ক’রলাম।সর্বজনহিতায়, আমার Department এর জন্যে, চামেলীর জন্যে, মার জন্যে আর KR এর জন্যে।কারা অমরনাথ গিয়েছে? কিছু লোক, তীর্থযাত্রী। সেখানে কোন বৈশিষ্ট্য নেই।বাঙালি, বিহারি, রাজস্থানী, পাঞ্জাবী সব দেশেরই বুড়বুড়িরা আছেকি কষ্ট করে যে তারা গেছে তা অবর্ণনীয়। যদি কষ্ট করাটা তীর্থ যাত্রার আনুষঙ্গিক হয় এরা full marks পাবে। কিন্তু আমার গভীর সন্দেহ হয় যে এত কষ্ট ক’রে ভগবানের পুজা করার মতো মনের অবস্থা থাকে কী?  অমরনাথ পায়ে হেঁটে যাওয়ার কি অবর্ণনীয় কষ্ট তা তোমাদের কথায় বোঝাতে পারব না। সেই কষ্ট করে গিয়ে আধ ঘণ্টা থেকে- এক ঘণ্টায়, তুষার লিঙ্গের সঙ্গে মনঃসংযোগ হয় কি?না কি কষ্ট করাটাই প্রয়োজনীয়- an end in itself.পাপক্ষয় হয়- আত্মশুদ্ধি হয়- পূজাটা খালি বহিরাঙ্গ – না করলেও চলে?কিছু বুড়ো বুড়ী চলেছে এ বিশ্বাস নিয়ে- যে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। অর্থা বাইরে দেখে মনে হয়  এরা কি ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে চলেছে?  ভীষণ dilemma লাগছে আমার মনে। কিছু লোক যাচ্ছে ডান্ডি করে। এরা বিড়লাদের সমগোত্রীয়। বিশ্বাস করে অমরনাথ গেলে পুন্য হয়। তারা পুন্য করতে যায় এবং হয়ত মনে মনে অনুভব করে যে তারা পুন্যবতী হল অমরনাথ যাত্রা করে। কিছু লোক যায় অমরনাথ বেড়াতে। লোকের কাছে গল্প করবে “আমি অমরনাথ গিয়েছি- সে যে কি কষ্ট – কি বোঝাব- আর তারপর তুষার লিঙ্গ দেখলাম- মনে মনে অভিভূত হয়ে গেলাম।– সবটাই ঠাঁট – ভুয়ো”
কিছু লোক যায় Adventure এর spirit  নিয়ে।“ সবাই বলে অমরনাথ যাওয়া নাকি কঠিন ব্যাপার- দেখাই যাক না”। কিছু লোক উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে যায়।  আচ্ছা চিন্তা কর, যে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য কি”?
এখানেই ডঃ কানাইলাল একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ভারতবর্ষের প্রায় সব মানুষই সারা জীবনে কমবেশি কিছু তীর্থযাত্রা করে থাকেন। কিন্তু ক’জনের মনে তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগে? তাঁর মনে শুধু প্রশ্নই জাগেনি, তিনি সেটা নিয়ে ভেবেওছেন এবং চিঠিতে লিখেছেন যে -
১) সাধুদের তীর্থযাত্রা অবশ্য করনীয়। সন্ন্যাসীরা পরিব্রাজক। সুতরাং পরিব্রজ্যার অঙ্গ হিসাবে এঁদের তীর্থযাত্রা করতেই হয়। সাধুরা সব সময়েই ব্রহ্মপথযাত্রী। তাঁদের মন সর্বদাই ঈশ্বরে সমর্পিত। কাজেই তীর্থযাত্রায় শারীরিক কষ্ট হলেও, গম্যস্থানে পৌঁছিয়ে মনঃসংযোগ  করতে দেরী হয়না।
২) তীর্থযাত্রায় যায় গৃহস্থ পুন্যকামীর দল। তীর্থ কথাটার derivative অর্থ অমরকোষ থেকে দেখতে হবে। মনে হয় তীরে স্থিতঃ অর্থাৎ গঙ্গা তীরে অবস্থিত বা অন্য পুন্য নদীর তীরে অবস্থিত জায়গাকে তীর্থ স্থান বলা হয়। অথবা যে জায়গায় গেলে সংসার সাগর পার হওয়া যায় তাহাকে তীর্থ স্থান বলে। এখণ দেখা  যাক, কেন, কোণও বিশিষ্ট স্থানে গেলে পুন্য হয়? যদি কোনও সাধু মহাত্মা কোনও জায়গায় তপস্যা করেন, সে জায়গা তীর্থস্থান হয়- যেমন নৈমিষারন্য। সাধু মহাত্মাদের অবস্থিতির ফলে, তাঁদের জ্ঞান বিজ্ঞান আলোচনার জন্য সে স্থান ক্রমে ক্রমে বৈশিষ্ট্য লাভ করে। চারিদিকের environment এমনই হয়ে যায় যে, সেখানে গেলেই মন সাংসারিক জীবনের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চায়- মনে হয় এই রকম জীবনই সার্থক জীবন। তীর্থের এই  environmentটাই ধর্মপথের সহায়ক হয়ে ওঠে। আমাদের চৈতন্যময় জগত সম্বন্ধে ধারনা অস্পষ্ট। যাহা জড় মনে করি আপাতদৃষ্টিতে, তাহাও চৈতন্যময় হতে পারে। কথিত আছে বৃন্দাবনে গাছেরাও কৃষ্ণনাম শোনে ও respond করে। অর্থাৎ এইরকম জায়গায় মন স্বভাবতই ধর্মপথগামী হয়। সাধারণ গৃহস্থ যায় তীর্থস্থানে, ওই চৈতন্যময় সংস্থার কিছুটা আহরণ করতে। বলা তো যায় না, যদি ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকে, সামান্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গই অজ্ঞান রূপ অন্ধকার দূর করতে পারে। এই আশা আর কি? আর তীর্থ স্থানে সাধু মহাত্মাদের দর্শন লাভ হয়। তাঁদের সঙ্গ লাভও additional attraction. সাধুরা নিরাবলম্বী। তাঁদের কোনও  অর্থ উপজীবিকা নেই। গৃহস্থেরা একটা chance পায় এঁদের সাহায্য করবার। আমা র মনে হয় যে গৃহস্থ তীর্থস্থানে গিয়ে  সাধুদের জন্য পয়সা খরচ করেনা- সে অন্যায় করে। কিছু সাধুরা হয়ত ভণ্ড। কিন্তু  কিছু সাধু তো আছেন যারা ভণ্ড নন। তাছাড়া  ভণ্ড সাধুও আনুষ্ঠানিক ভাবেই ভগবতানুরক্ত। ভড়ং দেখাবার জন্যও তো তারা ঈশ্বরের নাম করে। তাছাড়া তুমি আমি তাদের ভণ্ড মনে করার কে? নিজেদের  ভণ্ডামির কথা চিন্তা করে দেখেছি কি?
তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে এর থেকে  বলার মত আর বেশী কিছু নেই।
যাইহোক এত কথা লিখলাম এই জন্যে যে অমরনাথ যাত্রা, সত্যি করে শুভঙ্করী হতে গেলে অন্তত সাত আট দিন সময় নিয়ে আস্তে আস্তে যেতে হয়। পেছনে হুড়ো লাগিয়ে আজ চন্দনবাড়ী যেতে হবে, কাল শেষনাগ, পরশু পঞ্চতরণী, তার পরের দিন অমরনাথ। এমনি করলে যাওয়াই হয় অমরনাথে- কিন্তু তীর্থ করা হয় না। ভগবানের নাম করব কি- নিঃশ্বাস নিতেই ব্যস্ত সব সময়চারিদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করব কি- নিজের প্রান বাঁচাতেই ব্যতিব্যস্ত। যারা পথযাত্রী তাদের দিকে দেখব কি, নিজের পায়ের ব্যথাতেই ক্লিষ্ট। অন্য লোককে সাহায্য করব কি আমাকেই সাহায্য করলে মনে হয় ভাল হয়। এতে তীর্থ যাত্রা হয় না। আর একটা কথা বলে রাখি, কখনও মেলার সময়, ভিড়ের সময় তীর্থযাত্রায় আসতে নেই।  সে হাজার হাজার যাত্রী, কোথায় প্রস্রাব করছে কোথায় পায়খানা করছে, কি খাচ্ছে- তার ঠিকানা নেই। আমার ভাল লাগেনা।
এই চিঠি খানি পড়ে একটি বিষয়ে অবগত হওয়া গেল যে, জগৎ বিখ্যাত প্রফেসর  ডঃ মুখারজী পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হলেও প্রাচ্চের  জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অগাধ জ্ঞান ও গভীর উপলব্ধি ছিল তারপর   সেই  অমানসিক কষ্ট করে তিনি  অমরনাথ  পৌঁছে যখন পূজা দিলেন, কাদের উদ্দেশ্যে দিলেন ? না  সর্বজনহিতায়। অর্থা সকলের মঙ্গলের জন্যে ও গবেষণায় নিয়জিত তাঁর ছাত্র ছাত্রী গণের সাফল্যের জন্য, কন্যা সমা ছাত্রী চামেলীর জন্যে।কিন্তু নিজের জন্য বা নিজের সন্তানদের জন্য আলাদা করে কোনদিন কারো কাছে তিনি কিছু চাননি।যেমন পোশাক আশাক তেমনি খাওয়া দাওয়া। সব বিষয়েই অনাড়ম্বর সরলতায়ই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।আমিষ ভক্ষণ ছেড়ে ছিলেন একেবারে অল্প বয়সে সেই আই এস সি পড়ার সময় থেকে স্যুট বুটের বদলে খদ্দরের প্যান্ট শার্ট পরে পায়ে চপ্পল গলিয়ে মাথার টিকি দুলিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে হাসপাতালে মেডিকেল কলেজে ও ল্যাবে তো ঘুরে বেড়াতেনই, এমন কি আমেরিকায় ও যেতেন বিজ্ঞান সন্মেলনে ভাষণ দিতে।একবার  শীত কালে ঐভাবে সেখানে গিয়ে ঠাণ্ডা লাগায়, ছাত্রী চামেলীকে লেখেন, “ এখানে এত ঠাণ্ডা যে খদ্দরের জামা কাপড়ে আর চল্লনা। ব্যাগ থেকে গরম জামা কাপড় বের করতে হল”।                                                         

                                                                 

No comments:

Post a Comment