Friday, 26 August 2016

ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার

                                                      ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার        

রামু জন্মেছিল উত্তর প্রদেশের এক পাহাড়ি গ্রামে।চার ভাই বোনের মধ্যে সে সব থেকে ছোট হওয়ায় তার খাওয়াদাওয়া তেমন খুব একটা ভাল জুটত না।ফলে একরকম প্রায় নেচে কুঁদেই বাড়ছিল  সে তবে একটু বড় হতে যখন সে পাহাড়ের ঢালে, আশেপাশের গাঁয়ের বন্ধুদের সাথে মিলে,খেলে বেড়াতে লাগল তখন আর তার খাদ্য সমস্যা থাকল না সেই সব দিন গুলো রামুর বেশ আনন্দেই কাটছিল।তবে সে লক্ষ্য করত যে হঠা হঠাতার খেলার সাথীরা কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তারা কোথায় যায়? আর কেনই বা  ফেরে না ? এসব প্রশ্নের উত্তর সে কোন দিন কারো কাছে পায়নি। অবশেষে একদিন সে নিজেও হারিয়ে গেল। সে হারিয়ে গেল বলার থেকে বরং বলা ভাল যে, তাদের সেই ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, ঘাসের গালিচা পাতা সুন্দর উপত্যকা, টিনের চাল আর পাথরের দেয়ালের সুন্দর  সুন্দর বাড়ি গুলো, তার জীবন থেকে জীবনের মতো হারিয়ে গেল। নিজেকে সে আবিষ্কার করল কলকাতার খিদিরপুরের এক গলিতে। এখানকার জীবনের সঙ্গে তার উত্তর প্রদেশের দিন গুলোর অনেক ফারাক। এখানে স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, তার উপরে থাকতে হয় অনেকের সঙ্গে সেয়ার করে ছোট্ট একটা খুপরিতে এক কাকু ওদের, মানে ও আর ওর বন্ধুদের রোজ সকালে গড়ের মাঠে বেড়াতে নিয়ে যায়। সারাটা দিন তারা সেখানেই দৌড়া দৌড়ী খেলাধুলো করে কাটায়, খাওয়াদাওয়া ও সেখানেই সারে। তারপর সন্ধ্যার সময়  দল বেঁধে রাস্তার পর রাস্তা পার হয়ে ডেরায় ফিরে আসে। এই রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারটা রামুর একদম ভালো লাগেনা। দৈত্যের মতো বড় বড় বাস গুলো দেখলে ওর ভীষণ ভয় করে। কিন্তু এখানেও সে এসে থেকেই  লক্ষ্য করছিল যে, তাদের  বন্ধুদের  দল থেকে রোজই কেউ না কেউ  হারিয়ে যাচ্ছে। তারা কোথায় যে যাচ্ছে?কেনই বা আর ফিরে আসছেনা তা জানা যাচ্ছে না অবশেষে একদিন ভোর রাত্রে আধো ঘুমে তার মনে হল ক’জন লোক মুখে কাপড় বেঁধে, তাদের ঘরে ঢুকে এক একজন কে মুখ চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।এই দেখে আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠে উঠলকিন্তু তাতে লাভ কিছুই  হল নাএরপর প্রায় প্রতি দিনই ভোরে সে ঐ একই দৃশ্য দেখতে লাগল শেষে একদিন আর থাকতে না পেরে,  গড়ের  মাঠে বেড়াতে বেড়াতে তার এক বন্ধুকে  বলল –“জানিস তো রাত্রে আমরা যখন ঘুমাই তখন ক’জন জল্লাদ এসে আমাদের বন্ধুদের তুলে নিয়ে যায়।  তার পরে তাদের আর দেখা পাওয়া যায়না”।বন্ধুটি বললে –“এতো পুরন খবর। তুই এতদিনে  জানলি”?  
-“কিন্তু ওই লোক গুলো কারা? আর কেনই বা বিনা কারনে আমাদের বন্ধুদের  ধরে নিয়ে যায়”?
-“বিনা কারনে কেন হবে রে? তারা নিশ্চই খারাপ কাজ কিছু করে  ছিল? তাই  তো  তাদের  ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দিয়েছে”। 
-“কিন্তু ওরা তো সব সময় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরত। তাহলে  খারাপ কাজটা করলে  কখন"?
-“এ জন্মে না করলেও গতজন্মে করেছিল হয়ত? কিংবা ওর বাবা মা বা ভাই বনেরাও করে থকতে পারে”?
-“তার জন্যে এদের শাস্তি পেতে হবে”?   
-“এটাই তো চলছে এখানে জেনে রাখ একদিন আমাদেরও ওরকম  শস্তি পেতে হবে”। রামু তখন ঠিক করল যে এখানে আর থাকা ঠিক   নয়। যে করেই হ’ক পালাতে হবে। সন্ধ্যার সময় গড়ের মাঠ থেকে ফেরার পর,রাস্তায় লোকজন বিশেষ থাকে না। তখনই যা হয় কিছু  করতে হবে। এক সন্ধ্যায়, ফাঁক বুঝে রামু তাদের ডেরা থেকে একছুটে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পালাতে গেল। কিন্তু সামনে পড়ল দৈত্যাকৃতি এক বাস।ব্যাস, রামুর আর পালান হল নাভয় পেয়ে ব্যা.এ্যা এ্যা করে বিকট এক ডাক ছেড়ে, একছুটে সে আবার তার পুরন বাসাতেই আবার ফিরে গেল। এই দেখে রাস্তার  একজন লোক হেসে আরেকজন কে বললে-“দেখলি তো ছাগলটার বুদ্ধি ? আরে তুই ছাড়া পেয়েছিস, ব্যাটা  পালিয়ে বাঁচ ? তা নয় ব্যাটা বাস দেখে ভয় পেয়ে ভির্মি খেয়ে ঢুকল  গিয়ে আবার সেই কষাই খানায়, জবাই হতে”।    
-“ছাগল নয়রে ওটা মুলতানী পাঁঠা। মানুষের ভোগের জন্যেই তো  ওদের জন্ম। আর পালিয়েই বা যাবে টা কোথায়? যেখানে যাবে সেখানেই লোকে ধরে তাকে কেটে খাবে ভোগের জিনিষ ভোগে লেগে যাবে”।     
তাকে তখন পুরোপুরি সমর্থন জানাল একটি মেয়ে, যে সেই সময় সেজে  গুজে লাইট পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,বললে -  “একদম ঠিক বলেছেন আপনি।আমাদের পালাবার কোন যায়গা  নেই পালাতে গেলেই ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার হ্যে যাবে”।       

   তরুণ কুমার বন্দ্যপাধ্যায়।   ১৬ই ভাদ্র ১৮২৩ সন                                                        

Sunday, 21 August 2016

ছিন্ন মূল (৪)

 রঘু কাকা  চলে যেতে অতসী  দু টাকার পেটা পরোটা ঘুগনি আর জিলিপি কিনে  চলল নদীর পাড়ে। খেয়া ঘাটের কাছে হেলে পড়া বটগাছ তলায় ওর একটা প্রিয় জায়গা আছে।  হাটবারে হাটবারে ওখানে  বসেই ও  টিফিন করে।  তবে আজকে কিন্তু সেটা হ’ল না। গাছটার কাছে এসে দেখে যে ওর জায়গায় অন্য  কে একজন বসে ।  অন্যমনস্ক ভাবে একটু দূরে গিয়ে আন্য একটা গাছ তলায় গিয়ে বসল ও তারপর আজ সকাল থেকে ওকে ঘিরে যা যা ঘটেছে তা রোমন্থন করতে লাগলো আর অন্যমনস্ক ভাবে দেখতে লাগলো নদী বক্ষের দৃশ্য মাঝ নদীতে গদাইলশকরি চালে হেলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে খড় বোঝাই বড়  বড় বজরা। দাঁড় টেনে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে ছোট ছোট ছিপ নৌকোএখানে  সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে নৌকো গুলো।জলের বুকে খোলা আকাশের ছায়া পড়ছে,  নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রং এর তুলোট মেঘ। থেকে থেকে ডেকে উঠছে গাঙ চিলেরা। লম্বা লম্বা পা ফেলে নদীর পাড়ে মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে বকের দল। কেউ কেউ আবার এক ঠ্যাঙে ধ্যান করছে জলের দিকে তাকিয়ে। ছোট ছোট ছেলেরা গাছের ডাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর বুকে।ঠাণ্ডা  বাতাস ভেসে আসছে নদীর বুক থেকে। অন্য দিন এসব দৃশ্য ও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ  করলেও আজ কোথায় যেন বার বার তাল কেটে যাচ্ছে।  আসলে ওই ঘটক আর রমার কথা গুলোই ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে তার। হাতের খাবার গুলো সে কখনও  খাচ্ছে, কখনও বা অন্যমনস্ক হয়ে জলের দিকে তাকাচ্ছে খাওয়া শেষ হতে, হাতে ধরা শাল পাতার ঠোঙাটা দলা পাকিয়ে ফেলে  দিয়ে,গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ হাল্লাক হয়ে বসল সে। তারপর উদাস হয়ে আবার ভাবতে লাগল  নারী জীবনের অভিশাপের কথা। সেই যেদিন থেকে সে ডাগরটি হয়েছে পুরুষের দৃষ্টি তাকে বিরক্ত করে মারছে। বয়সের কোন বাছ বিচার নেই।সে যেন সকলেরই লালসার বস্তু, চলমান একটা খাদ্য বিশেষ। সবে তো তার উনিশ কি কুড়ি বছর বয়স। বাঁচতে হবে এখনও অনেক বছর। তা কি এই ভাবে ? বিয়েটাই কি একটা মেয়ের জীবনের শেষ কথা ? না হলে কি তাকে পদে পদে অপদস্ত হতে হবে ? একজন পুরুষ যদি এই সমাজের বুকে বিয়ে না করেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, তবে একটা মেয়েই বা তা পারবেনা কেন ? কেনই বা শুধু শুধু তার নামে বদনাম রটান হবে ? ঠিকই বলত  মা, সংসার বড় শক্ত ঠাঁই। এখানে একা এক মেয়ে মানুষের শান্তিতে বাঁচা দায়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়াল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী  খেলনা বেহালাটার দিকে। মায়ের যে প্রিয় গানটি মা মাঝে মঝে বাজাত,এই মুহূর্তে সেই গানের সুরটি ই  তার কানে বাজছে সে সেটাই বাজাতে লাগল-“উথালী পাথালী আমার বু.উ.উ..উ..ক,আ মা.আ আ র মুনেতে নাইসু.উ.উ..উ খ  রে।ও আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে......। অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে। একাকী বিষণ্ণা নারী  অতসী, নদী তীরে তার নিজের সৃষ্ট সুরের মূর্ছনায় সে নিজেই তন্ময় হয়ে হারিয়ে গেল তার আশেপাশে  কি যে  ঘটছে  তা নিয়ে তার কোন হুঁশই নেই। সম্বিত ফিরল বাঁশির সুরে। চমকে উঠে  মুখ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ওর সেই প্রিয় জায়গাটায় বসে এক যুবক ওর গানেরই সুরে বাঁশি  বাজাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাজনা থামিয়ে দিল। নারীর সহজাত বুদ্ধি বিবেচনা তাকে সাবধান করে দিল। আজ হাটবার, একশ একটা বাজে লোক ঘুরছে চেনা নেই শোনা নেই অচেনা এক ছোঁড়ার সঙ্গে সে নদীর পাড়ে গাছ  তলায় বসে  বাজনার যুগলবন্দী করছে। এই খবরটা চাউর হলে গাঁয়ে গাঁয়ে এক্ষুনি ডি ডি পড়ে যাবে।  কিছু না করেই যখন তার বদনাম রটছে,আর এটা একবার রটলে তো আর দেখতে হবে  না।  সে আর কাল বিলম্ব না করে উঠে পড়ল। ত্রস্ত পায়ে হাঁটা দিল হাটের পানে।অতসী বাজনা বন্ধ করার  সাথে সাথে যুবকটিও তার বাঁশি বাজান বন্ধ করে দিয়ে উঠে পড়েছিল, এবার অতসীকে উঠতে দেখে,   সে এগিয়ে এলো। কাছে এসে হেসে বলল –কোথায় বাড়ি গো তোমার ?বেড়ে হাত ত তোমার? মাত্তর  একটা মাটির খেলনা তুমি যে এতো সুন্দর করে বাজালে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বেস হতনা। কার কাছে শিখেছ?  অতসী গম্ভীর গলায় বিরক্তির সঙ্গে জবাব দিল আমার মায়ের কাছে।  সর দিকিনি বাপু, এবার আমায় যেতি দাও দেখি ? ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে। ছেলেটি তেমনি হেসে বললে- ঠিক আছে যাও। তবে আমি কিন্তু এগাঁয়ের লোক নই। নদীর জলে ভেসে এসেছি ওই যে দেখছ ওই  নৌকাটা, ওটাই আমার ঘরওতে চেপে আমি দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াই। যখন যেখানে ইচ্ছা হয়  দুএক মাস থাকি, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি। এখন এখানে আমি ক’দিন এই গাছ তলাতেই  থাকব। সময় পেলে এসো, দেশবিদেশের গল্প শোনাব।আর তোমার ওই মাটির ব্যায়লাটাও সঙ্গে এনো। গান শুনব”। অতসী বললে-“ হুঁঃ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই  তোমায় গান শোনাতে আসি, সর তো বাপু ঢের কাজ পড়ে আছে,  যেতি দাও। অতসী হন হন করে হাঁটা দ্যে ফিরে এলে আবার  হাটে। এখানে সেখানে  দুএকটা দোকানে তোলা কিছু কাজ করে দিয়ে, নিজের বেচাকেনার জিনিষ আর আনাজপ্ত্র গুলো তার  ঝুড়িতে ঝোলায় ভোরে, সন্ধ্যার মুখে হাঁটা   দিলে গাঁয়ের পানে।                    

Monday, 1 August 2016

ছিন্ন মুল(২)

পূবাকাশ লাল করে ভোরের সূর্য সবে উঠছে ।মাঘ মাসের  বাতাসে  ঠাণ্ডা শির শিরিনি ভাব। সুন্দর সুবাসে মথিত বনভূমি,  গাছে  গাছে পাখি ডাকছে , ছানা পোনা নিয়ে মুরগীরা বেরিয়ে পড়েছে পোকার  খোঁজে। গলা লম্বা করে ডানা ঝাপটে কোঁ কোঁর কোঁ করে  ডেকে উঠছে মোরগ গুলো। মেঠো পথের ধূলো ভোরের শিশিরে ভিজে জমাট বেঁধে আছে জায়গায় জায়গায় হাল্কা কুয়াশায় ঢাকা পথের ধারে আকন্দের  ঝোপে শিশিরে ভেজা মাকড়সার জাল,  আলো পড়ে রামধনু রঙে ঝকমক করছে ।  অতসী ওর  মায়ের মতো খেলনা  বেহালা হাতে বেরিয়ে  পড়েছে গাঁয়ের পথে ফেরি করতে।  এখন ও বাজাচ্ছে  একটা প্রচলিত লোক গীতি-“  বলি ও ননদী আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে ......”,  বাঁয়ে পড়ল মোড়লদের বড় পুকুর। এই শীতের  ভোরেও অনেকে চান করতে জলে নেমেছে  তার সঙ্গে পুকুর ঘাটে বাসন মাজা কাপড় কাচা চলেছে। অতসীর কানে এল মেয়েলি গলায় কে একজন বলল- “মেয়েটার দিষ্টি দেখেছ, ঠিক যেন সাপের চাউনি”।  ব্যাস অমনি শুরু হয়ে গেল ওকে নিয়ে কথা।  
-“হবে না ? কার মেয়ে বল ? বলি আম গাছে কি জাম ফলে ? ডাইনির মেয়ে তো ডাইনীই হবে”?  
-“হ্যাঁ গো দিদি যা বলেছ তাই,  আমার বাপের বাড়ি জামরুল তলায়ও অমনি একজন ছ্যালো। সে  পোয়াতি  মেয়ের পেটে বাচ্ছা দেখতি পেত,মানসের শরীলে অক্ত চলছে  দেখতি পেত, কচি ছেলে মেয়ের অক্ত চুষী খেত তা সে ঝ্যাখন মোল, একটা বেড়াল কে ডাইনী বাইনে গেল, তা সে বেড়ালটাও...
-“ আঃ তুই থামবি মানদা? বলি সক্কাল সক্কাল এইসব অলুক্ষুনে কথা গুলো কি না বললেই নয় গা”? মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন মোড়ল গিন্নী। অতসী শুনে ও না শোনার ভান করে এগিয়ে চলল। ডাইনে পড়ল  বিশ্বাস বাড়ি। প্যাঁক  প্যাঁক করে এক দল পাতিহাঁস হেলতে দুলতে সার বেঁধে, ওর সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে পুকুরে নেমে গেল। বিশ্বেস মাসীমা রান্নাঘরের জানালা দিয়ে  ডেকে বললেন-“ও অতসী ওবেলা এক  গোছা পান দিয়ে যাস তো মা, ফুরিয়ে গেছে”।  মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে, হ্যাঁ বলে এগিয়ে চলল সে। বাঁয়ে পড়ল  মুখুজ্যে বাড়ি। বেড়ায় হাত দিয়ে ছোট বৌটি দাঁড়িয়ে ছিল অতসীর অপেক্ষাতেই, ওকে দেখে বললে-“ও অতসী আমচুর আর নেবুর আচার দিয়ে যাস তো লো  ”? বৌটা ওর সমবয়সী, বছর খানেক হ’ল বিয়ে হয়েছে। অতসী মুখ টিপে হেসে  বললে –“ও খোকা হবে বুঝি”? সলজ্জ হেসে বউটি পালাল ত্রস্ত পায়ে।  এগিয়ে চলল অতসী তার খেলনা  বেহালায় সুর তুলে কুমোর পাড়ায় ঢোকার মুখে দূর থেকে শুনতে পেল  ঠপ্ ঠপাঠপ কাঁচা কলসি পেটানর শব্দআর সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে মাটির দাওয়ায়  বসে,     ম্যালেরিয়া রোগে শীর্ণ হাড় জিরজিরে , মনটু্র সুর করে পড়া কবিতা। কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ী  বোঝাই করা কলসী হাঁড়ি.........বেহালার সুর শুনে, পড়া থামিয়ে সে হেসে  বললে –“কি রে দিদি  এনেছিস?” বেহালা থামিয়ে অতসী হেসে বললে-“না রে পাই নি”।  অভিমানের সুরে মনটু্ বললে –“ভারী  দুষ্টু তুই অতসী দিদি, আজও আনলি না আমার কুলের আচার”। অতসী বললে –“কী করব রে ভাই, পাচ্ছি না যে?”  তারপর তার গাল টিপে আদর করে বলেল –“  রাগ করিসনে  ভাই , পেলেই এনে দেব”  আসলে ইচ্ছে করেই অতসী এড়িয়ে যাচ্ছে তার কুপথ্যের  বায়না।  আবার এগিয়ে চলল অতসী বেহালা বাজিয়ে। পিছনে পড়ে রইল ঘূর্ণায়মান কুমোরের চাকে মাটির হাঁড়ী কলসি পণের ধোঁয়া  আর  মনটু্র সুর করে পড়া  -  কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ী ......। পথের  ধারে বিষ্টু  মাষ্টার একটা খাম হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওকে দেখে বললেন-“ ও অতসী  হাটে যাচ্ছিস ? তা এই চিঠিটা একটু ডাকবাক্সে  ফেলে দিস তো মা”। অতসী হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে খাম টা নিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে চলল সে, এখনও তাকে যেতে হবে অনেকটা পথ।সামনে কামার পাড়া, দূর থেকে ভেসে আসছে একটানা ঠুং ঠুং ঠ্যাং ঠ্যাং ঠক ঠক শব্দ। কামারেরা কামারশালে হাপর টেনে হাতুড়ি পিটে কাস্তে দা, কুড়ুল লাঙল, গোরুর গাড়ির চাকা বানাচ্ছে। অতসী কাছে আসতেই নিতাই কামার বললে –“ ও অতসী হাটের পালান হাজরাকে শুধস তো আমার মাল গুলো এলো কিনা”?
তার পাশে উবু হয়ে বসা বৃদ্ধ কামার হরিহর, এক মুখ পাকা দাড়ি গোঁফ এর ফাঁকে হুঁকো টানতে টানতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললে –“ আর কত দিন একা একা ঘুরবি রে অতসী ?  এবার একটা বে থা কর না”?  অতসী দাঁড়িয়ে পড়ে বললে –“ কি যে বল না তুমি ঠাকুরদা, কে করবে আমায় বে ? থাকি তো জঙ্গলে, তায় ডাইনি বুড়ির মেয়ে”? হরিহর হাসতে হাসতে  বললে –“ তা  যদি বলিস তাহলে আমিই না হয়...”।
-“ থাক তোমায় আর উবগার করতে হবে নাবলি দুদিন পরে তো  তুমি এমনিই পটোল তুলবে, আর  মাঝখান থেকে  বদনাম হবে আমার। লোকে বলবে ওই ডাইনি রাক্ষুসীটাই খেয়ে ফেলেছে ওকে”হাসতে  হাসতে পা বাড়াল অতসী। নিজের বিয়ে নিয়ে ও লোকের সঙ্গে যতই হাসি মস্করা করুক না কেন? বিয়ের যে একটু যে ইচ্ছে  হয় না তা নয়। বিশেষ করে মা চলে যাবার পর থেকে নিজেকে বড় একা একা লাগে ওর তবে সত্যিই তো কে করবে ওকে বিয়ে ? মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ওর বিয়ে দেয়।ওর বয়স যখন বছর পনে্র, সেই সময় একটা ঘটনার পর মা ওকে বলেছিল-“ অতসী এবার তুই একটা বিয়ে কর।আমার কিছু একটা হয়ে গেলে,তখন তুই একেবারে একা হয়ে পড়বি। তখন এখানে একা তুই বাঁচবি কীভাবে, দেখলি   তো  অসভ্য বখাটে ছেলে গুলো কিরকম নোংরা টিটকিরি দিল”?  ও বলেছিল –“ গায়ে তো আর ফোস্কা পড়ে নি মা”?  কিন্তু জবাবটা আমি কেমন দিলাম  বল”? হ্যাঁ সত্যি সেবার একেবারে মুখের মতো জবাব দিয়ে ছিল ওমা ও বুঝেছিল যে ওকে সে যতটা কাঁচা মেয়ে ভাবে, অতটা সে নয়। বরং তার  থেকে  ঢের  বেশী চালাক ঘটনাটা ঘটে ছিল একটা ভিন গাঁয়ের মাঝ মাঠে। সন্ধ্যার মুখে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মাঠ ভেঙ্গে ওরা মা মেয়েতে ঘরে ফিরছিল। ঠিক মাঝ মাঠে একটা ক্লাব ঘরে ক’টা ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সন্ধ্যার সময়ে ওদের দুজন  কে দেখে তারা হৈ হৈ করে উঠল। কয়েকজন আবার মুখে আঙুল গুঁজে সিটিও মারল। একটি ছেলে অঙ্গ ভঙ্গী করে বললে –“বলি এদিকে কোথায় যাচ্ছ গো তোমরা ? এস না রাতটা আমাদের এখানে কাটিয়ে যাও না”? অতসীর মা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হিশ হিশ করে বলেছিল –“তাকাস না ওদের দি্কে”তারপর শক্ত হাতে ওর হাতটা ধরে বলেছিল-“পা চালিয়ে চল”। অতসী কিন্তু পালায় নি।মায়ের হাত ছাড়িয়ে, তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমান তেজে জবাব দিয়ে ছিল –“ আপনারা আমাদের বাবা ভাই গুরুজন, অসহায় গরীব মেয়ে মানুষদের রক্ষাকর্তা। তা রাতের আশ্রয়টা  যখন দিতে  চাইছেন সে তো ভাল কথা। তা এখানে কেন? সাহস থাকে তো বাড়িতে নিয়ে চলুন না”? ছেলে গুল রনে ভঙ্গ দিয়ে ছিল। অতসীর মা বুঝে ছিল ওকে নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই। এ মেয়ে পারবে নিজেকে একা  সামলাতে। মায়ের কথা মনে পড়লে এখনও ওর চোখে জল এসে যায়। আঁচলে চোখ মুছে এগিয়ে চলল ও।                          ক্রমশঃ