ফ্রাইং প্যান টু ফায়ার
রামু জন্মেছিল উত্তর প্রদেশের এক পাহাড়ি
গ্রামে।চার ভাই বোনের মধ্যে সে সব থেকে ছোট হওয়ায় তার খাওয়াদাওয়া তেমন খুব একটা ভাল জুটত না।ফলে একরকম প্রায় নেচে কুঁদেই বাড়ছিল সে। তবে একটু বড় হতে যখন সে পাহাড়ের ঢালে,
আশেপাশের গাঁয়ের বন্ধুদের সাথে মিলে,খেলে বেড়াতে লাগল তখন আর তার খাদ্য সমস্যা
থাকল না। সেই সব দিন গুলো রামুর বেশ আনন্দেই কাটছিল।তবে সে লক্ষ্য করত যে হঠাৎ হঠাৎ তার খেলার সাথীরা কেউ
কেউ হারিয়ে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তারা কোথায় যায়? আর কেনই বা ফেরে না ? এসব প্রশ্নের উত্তর সে কোন দিন কারো
কাছে পায়নি। অবশেষে একদিন সে নিজেও হারিয়ে গেল। সে হারিয়ে গেল বলার থেকে বরং বলা
ভাল যে, তাদের সেই ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, ঘাসের গালিচা পাতা সুন্দর উপত্যকা,
টিনের চাল আর পাথরের দেয়ালের সুন্দর সুন্দর
বাড়ি গুলো, তার জীবন থেকে জীবনের মতো হারিয়ে গেল। নিজেকে সে আবিষ্কার করল কলকাতার খিদিরপুরের
এক গলিতে। এখানকার জীবনের সঙ্গে তার উত্তর প্রদেশের দিন গুলোর অনেক ফারাক। এখানে
স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, তার উপরে থাকতে হয় অনেকের সঙ্গে সেয়ার করে ছোট্ট একটা
খুপরিতে। এক কাকু ওদের, মানে ও
আর ওর বন্ধুদের রোজ সকালে গড়ের মাঠে বেড়াতে নিয়ে যায়। সারাটা দিন তারা সেখানেই দৌড়া দৌড়ী খেলাধুলো করে কাটায়, খাওয়াদাওয়া
ও সেখানেই সারে। তারপর সন্ধ্যার সময় দল
বেঁধে রাস্তার পর রাস্তা পার হয়ে ডেরায় ফিরে আসে। এই রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারটা
রামুর একদম ভালো লাগেনা। দৈত্যের মতো বড় বড় বাস গুলো দেখলে ওর ভীষণ ভয় করে। কিন্তু এখানেও সে এসে থেকেই লক্ষ্য করছিল যে, তাদের বন্ধুদের
দল থেকে রোজই কেউ না কেউ হারিয়ে
যাচ্ছে। তারা কোথায় যে যাচ্ছে?কেনই বা আর ফিরে আসছেনা তা জানা যাচ্ছে না। অবশেষে একদিন ভোর রাত্রে
আধো ঘুমে তার মনে হল ক’জন লোক মুখে কাপড় বেঁধে, তাদের ঘরে ঢুকে এক একজন কে মুখ
চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।এই দেখে আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠে উঠল।কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হল না। এরপর প্রায় প্রতি দিনই ভোরে সে ঐ একই দৃশ্য দেখতে লাগল। শেষে একদিন আর থাকতে না
পেরে, গড়ের মাঠে বেড়াতে বেড়াতে তার এক বন্ধুকে বলল –“জানিস তো রাত্রে আমরা যখন ঘুমাই তখন ক’জন
জল্লাদ এসে আমাদের বন্ধুদের তুলে নিয়ে যায়।
তার পরে তাদের আর দেখা পাওয়া যায়না”।বন্ধুটি বললে –“এতো পুরন খবর। তুই এতদিনে
জানলি”?
-“কিন্তু ওই লোক গুলো
কারা? আর কেনই বা বিনা কারনে আমাদের বন্ধুদের ধরে নিয়ে যায়”?
-“বিনা কারনে কেন হবে
রে? তারা নিশ্চই খারাপ কাজ কিছু করে ছিল?
তাই তো তাদের ধরে
নিয়ে গিয়ে শাস্তি দিয়েছে”।
-“কিন্তু ওরা তো সব
সময় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরত। তাহলে খারাপ
কাজটা করলে কখন"?
-“এ জন্মে না করলেও
গতজন্মে করেছিল হয়ত? কিংবা ওর বাবা মা বা ভাই বনেরাও করে থকতে পারে”?
-“তার জন্যে এদের শাস্তি
পেতে হবে”?
-“এটাই তো চলছে এখানে। জেনে রাখ একদিন আমাদেরও ওরকম শস্তি পেতে হবে”। রামু তখন ঠিক করল যে এখানে আর
থাকা ঠিক নয়। যে করেই হ’ক পালাতে হবে। সন্ধ্যার সময় গড়ের
মাঠ থেকে ফেরার পর,রাস্তায় লোকজন বিশেষ থাকে না। তখনই যা হয় কিছু করতে হবে। এক সন্ধ্যায়, ফাঁক বুঝে রামু তাদের
ডেরা থেকে একছুটে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পালাতে গেল। কিন্তু সামনে পড়ল দৈত্যাকৃতি এক
বাস।ব্যাস, রামুর আর পালান হল না।ভয় পেয়ে ব্যা.এ্যা এ্যা করে বিকট
এক ডাক ছেড়ে, একছুটে সে
আবার তার পুরন বাসাতেই আবার ফিরে গেল। এই দেখে রাস্তার একজন লোক হেসে আরেকজন কে বললে-“দেখলি তো ছাগলটার
বুদ্ধি ? আরে তুই ছাড়া পেয়েছিস, ব্যাটা পালিয়ে বাঁচ ? তা নয় ব্যাটা বাস দেখে ভয় পেয়ে
ভির্মি খেয়ে ঢুকল গিয়ে আবার সেই কষাই খানায়,
জবাই হতে”।
-“ছাগল নয়রে ওটা
মুলতানী পাঁঠা। মানুষের ভোগের জন্যেই তো
ওদের জন্ম। আর পালিয়েই বা যাবে টা কোথায়? যেখানে যাবে সেখানেই লোকে ধরে তাকে
কেটে খাবে। ভোগের জিনিষ ভোগে লেগে
যাবে”।
তাকে তখন পুরোপুরি সমর্থন
জানাল একটি মেয়ে, যে সেই সময় সেজে গুজে
লাইট পোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,বললে -
“একদম ঠিক বলেছেন আপনি।আমাদের পালাবার কোন যায়গা নেই। পালাতে গেলেই ফ্রাইং প্যান
টু ফায়ার হ্যে যাবে”।
তরুণ কুমার
বন্দ্যপাধ্যায়। ১৬ই ভাদ্র ১৮২৩ সন