। পূবাকাশ লাল করে ভোরের সূর্য সবে উঠছে ।মাঘ
মাসের বাতাসে ঠাণ্ডা শির শিরিনি ভাব। সুন্দর সুবাসে মথিত বনভূমি,
গাছে গাছে পাখি ডাকছে , ছানা পোনা নিয়ে মুরগীরা
বেরিয়ে পড়েছে পোকার খোঁজে। গলা লম্বা করে
ডানা ঝাপটে কোঁ কোঁর কোঁ করে ডেকে উঠছে
মোরগ গুলো। মেঠো পথের ধূলো ভোরের শিশিরে ভিজে জমাট বেঁধে আছে জায়গায় জায়গায় ।হাল্কা
কুয়াশায় ঢাকা পথের ধারে
আকন্দের ঝোপে শিশিরে ভেজা মাকড়সার জাল, আলো পড়ে রামধনু রঙে ঝকমক করছে । অতসী ওর মায়ের মতো খেলনা বেহালা হাতে বেরিয়ে পড়েছে গাঁয়ের পথে ফেরি করতে। এখন ও বাজাচ্ছে একটা প্রচলিত লোক গীতি-“ বলি ও ননদী আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে
......”, বাঁয়ে পড়ল মোড়লদের বড় পুকুর। এই শীতের
ভোরেও অনেকে চান করতে জলে নেমেছে । তার সঙ্গে পুকুর ঘাটে বাসন মাজা কাপড় কাচা
চলেছে। অতসীর কানে এল মেয়েলি গলায় কে একজন বলল- “মেয়েটার দিষ্টি দেখেছ, ঠিক যেন
সাপের চাউনি”। ব্যাস অমনি শুরু হয়ে গেল
ওকে নিয়ে কথা।
-“হবে না ? কার মেয়ে বল ? বলি আম গাছে কি জাম ফলে ? ডাইনির মেয়ে তো ডাইনীই হবে”?
-“হ্যাঁ গো
দিদি যা বলেছ তাই, আমার বাপের বাড়ি জামরুল
তলায়ও অমনি একজন ছ্যালো। সে পোয়াতি মেয়ের পেটে বাচ্ছা দেখতি পেত,মানসের শরীলে অক্ত
চলছে দেখতি পেত, কচি ছেলে মেয়ের অক্ত চুষী
খেত। তা সে ঝ্যাখন মোল, একটা বেড়াল
কে ডাইনী বাইনে গেল, তা সে বেড়ালটাও...
-“ আঃ তুই
থামবি মানদা? বলি সক্কাল সক্কাল এইসব অলুক্ষুনে কথা গুলো কি না বললেই নয় গা”? মুখ
ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন মোড়ল গিন্নী। অতসী শুনে ও না শোনার ভান করে এগিয়ে চলল। ডাইনে
পড়ল বিশ্বাস বাড়ি। প্যাঁক প্যাঁক করে এক দল পাতিহাঁস হেলতে দুলতে সার
বেঁধে, ওর সামনে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে পুকুরে নেমে গেল। বিশ্বেস মাসীমা রান্নাঘরের
জানালা দিয়ে ডেকে বললেন-“ও অতসী ওবেলা এক গোছা পান দিয়ে যাস তো মা, ফুরিয়ে গেছে”। মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে, হ্যাঁ বলে এগিয়ে চলল সে। বাঁয়ে
পড়ল মুখুজ্যে বাড়ি। বেড়ায় হাত দিয়ে ছোট
বৌটি দাঁড়িয়ে ছিল অতসীর অপেক্ষাতেই, ওকে দেখে বললে-“ও অতসী আমচুর আর নেবুর আচার
দিয়ে যাস তো লো ”? বৌটা ওর সমবয়সী, বছর
খানেক হ’ল বিয়ে হয়েছে। অতসী মুখ টিপে হেসে বললে –“ও খোকা হবে বুঝি”? সলজ্জ হেসে বউটি পালাল
ত্রস্ত পায়ে। এগিয়ে চলল অতসী তার খেলনা বেহালায় সুর তুলে। কুমোর পাড়ায় ঢোকার মুখে দূর থেকে শুনতে
পেল ঠপ্ ঠপাঠপ কাঁচা কলসি পেটানর শব্দ। আর সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে মাটির দাওয়ায় বসে, ম্যালেরিয়া
রোগে শীর্ণ হাড় জিরজিরে , মনটু্র সুর করে পড়া কবিতা। কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ী বোঝাই করা কলসী হাঁড়ি.........বেহালার সুর শুনে,
পড়া থামিয়ে সে হেসে বললে –“কি রে দিদি এনেছিস?” বেহালা থামিয়ে অতসী হেসে বললে-“না রে
পাই নি”। অভিমানের সুরে মনটু্ বললে –“ভারী
দুষ্টু তুই অতসী দিদি, আজও আনলি না আমার
কুলের আচার”। অতসী বললে –“কী করব রে ভাই, পাচ্ছি না যে?” তারপর তার গাল টিপে আদর করে বলেল –“ রাগ করিসনে ভাই , পেলেই এনে দেব” আসলে ইচ্ছে করেই অতসী এড়িয়ে যাচ্ছে তার কুপথ্যের
বায়না। আবার এগিয়ে চলল অতসী বেহালা বাজিয়ে। পিছনে পড়ে
রইল ঘূর্ণায়মান কুমোরের
চাকে মাটির হাঁড়ী কলসি পণের ধোঁয়া আর মনটু্র সুর করে পড়া - কুমোর
পাড়ার গোরুর গাড়ী ......। পথের ধারে
বিষ্টু মাষ্টার একটা খাম হাতে দাঁড়িয়ে
ছিলেন। ওকে দেখে বললেন-“ ও অতসী হাটে
যাচ্ছিস ? তা এই চিঠিটা একটু ডাকবাক্সে
ফেলে দিস তো মা”। অতসী হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে খাম টা নিয়ে নিল। তারপর এগিয়ে
চলল সে, এখনও তাকে যেতে হবে অনেকটা পথ।সামনে কামার পাড়া, দূর থেকে ভেসে আসছে
একটানা ঠুং ঠুং ঠ্যাং ঠ্যাং ঠক ঠক শব্দ। কামারেরা কামারশালে হাপর টেনে হাতুড়ি পিটে
কাস্তে দা, কুড়ুল লাঙল, গোরুর গাড়ির চাকা বানাচ্ছে। অতসী কাছে আসতেই নিতাই কামার
বললে –“ ও অতসী হাটের পালান হাজরাকে শুধস তো আমার মাল গুলো এলো কিনা”?
তার পাশে উবু
হয়ে বসা বৃদ্ধ কামার হরিহর, এক মুখ পাকা দাড়ি গোঁফ এর ফাঁকে হুঁকো টানতে টানতে
কাঁপা কাঁপা গলায় বললে –“ আর কত দিন একা একা ঘুরবি রে অতসী ? এবার একটা বে থা কর না”? অতসী দাঁড়িয়ে পড়ে বললে –“ কি যে বল না তুমি
ঠাকুরদা, কে করবে আমায় বে ? থাকি তো জঙ্গলে, তায় ডাইনি বুড়ির মেয়ে”? হরিহর হাসতে
হাসতে বললে –“ তা যদি বলিস তাহলে আমিই না হয়...”।
-“ থাক তোমায় আর উবগার করতে হবে না। বলি
দুদিন পরে তো তুমি এমনিই পটোল তুলবে, আর মাঝখান থেকে বদনাম হবে আমার। লোকে বলবে ওই ডাইনি রাক্ষুসীটাই
খেয়ে ফেলেছে ওকে”। হাসতে হাসতে পা বাড়াল অতসী। নিজের বিয়ে নিয়ে ও লোকের সঙ্গে যতই
হাসি মস্করা করুক না কেন? বিয়ের যে একটু যে ইচ্ছে হয় না তা নয়। বিশেষ করে মা চলে যাবার পর থেকে নিজেকে
বড় একা একা লাগে ওর। তবে সত্যিই তো কে
করবে ওকে বিয়ে ? মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ওর বিয়ে দেয়।ওর বয়স যখন বছর পনে্র, সেই সময়
একটা ঘটনার পর মা ওকে বলেছিল-“ অতসী এবার তুই একটা বিয়ে কর।আমার কিছু একটা হয়ে
গেলে,তখন তুই একেবারে একা হয়ে পড়বি। তখন এখানে একা তুই বাঁচবি কীভাবে, দেখলি তো অসভ্য
বখাটে ছেলে গুলো কিরকম নোংরা টিটকিরি দিল”? ও বলেছিল –“ গায়ে তো আর ফোস্কা পড়ে নি মা”? কিন্তু জবাবটা আমি কেমন দিলাম বল”? হ্যাঁ সত্যি সেবার একেবারে মুখের মতো জবাব
দিয়ে ছিল ও।মা ও বুঝেছিল যে ওকে সে
যতটা কাঁচা মেয়ে ভাবে, অতটা সে নয়। বরং তার থেকে ঢের
বেশী চালাক । ঘটনাটা ঘটে ছিল একটা ভিন গাঁয়ের মাঝ মাঠে। সন্ধ্যার মুখে তাড়াতাড়ি পা
চালিয়ে মাঠ ভেঙ্গে ওরা মা মেয়েতে ঘরে ফিরছিল। ঠিক মাঝ মাঠে একটা ক্লাব ঘরে ক’টা
ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সন্ধ্যার সময়ে ওদের দুজন কে দেখে তারা হৈ হৈ করে উঠল। কয়েকজন আবার মুখে
আঙুল গুঁজে সিটিও মারল। একটি ছেলে অঙ্গ ভঙ্গী করে বললে –“বলি এদিকে কোথায় যাচ্ছ গো
তোমরা ? এস না রাতটা আমাদের এখানে কাটিয়ে যাও না”? অতসীর মা ওর কানের কাছে মুখ
নিয়ে হিশ হিশ করে বলেছিল –“তাকাস না ওদের দি্কে”। তারপর
শক্ত হাতে ওর হাতটা ধরে বলেছিল-“পা চালিয়ে
চল”। অতসী কিন্তু পালায় নি।মায়ের হাত ছাড়িয়ে, তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমান তেজে
জবাব দিয়ে ছিল –“ আপনারা আমাদের বাবা ভাই গুরুজন, অসহায় গরীব মেয়ে মানুষদের
রক্ষাকর্তা। তা রাতের আশ্রয়টা যখন দিতে চাইছেন সে তো ভাল কথা। তা এখানে কেন? সাহস থাকে
তো বাড়িতে নিয়ে চলুন না”? ছেলে গুল রনে ভঙ্গ দিয়ে ছিল। অতসীর মা বুঝে ছিল ওকে নিয়ে
আর কোন চিন্তা নেই। এ মেয়ে পারবে নিজেকে একা সামলাতে। মায়ের কথা মনে পড়লে এখনও ওর চোখে জল
এসে যায়। আঁচলে চোখ মুছে এগিয়ে চলল ও। ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment