Sunday, 21 August 2016

ছিন্ন মূল (৪)

 রঘু কাকা  চলে যেতে অতসী  দু টাকার পেটা পরোটা ঘুগনি আর জিলিপি কিনে  চলল নদীর পাড়ে। খেয়া ঘাটের কাছে হেলে পড়া বটগাছ তলায় ওর একটা প্রিয় জায়গা আছে।  হাটবারে হাটবারে ওখানে  বসেই ও  টিফিন করে।  তবে আজকে কিন্তু সেটা হ’ল না। গাছটার কাছে এসে দেখে যে ওর জায়গায় অন্য  কে একজন বসে ।  অন্যমনস্ক ভাবে একটু দূরে গিয়ে আন্য একটা গাছ তলায় গিয়ে বসল ও তারপর আজ সকাল থেকে ওকে ঘিরে যা যা ঘটেছে তা রোমন্থন করতে লাগলো আর অন্যমনস্ক ভাবে দেখতে লাগলো নদী বক্ষের দৃশ্য মাঝ নদীতে গদাইলশকরি চালে হেলতে দুলতে ভেসে যাচ্ছে খড় বোঝাই বড়  বড় বজরা। দাঁড় টেনে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে ছোট ছোট ছিপ নৌকোএখানে  সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে নৌকো গুলো।জলের বুকে খোলা আকাশের ছায়া পড়ছে,  নীল আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা রং এর তুলোট মেঘ। থেকে থেকে ডেকে উঠছে গাঙ চিলেরা। লম্বা লম্বা পা ফেলে নদীর পাড়ে মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে বকের দল। কেউ কেউ আবার এক ঠ্যাঙে ধ্যান করছে জলের দিকে তাকিয়ে। ছোট ছোট ছেলেরা গাছের ডাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর বুকে।ঠাণ্ডা  বাতাস ভেসে আসছে নদীর বুক থেকে। অন্য দিন এসব দৃশ্য ও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ  করলেও আজ কোথায় যেন বার বার তাল কেটে যাচ্ছে।  আসলে ওই ঘটক আর রমার কথা গুলোই ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে তার। হাতের খাবার গুলো সে কখনও  খাচ্ছে, কখনও বা অন্যমনস্ক হয়ে জলের দিকে তাকাচ্ছে খাওয়া শেষ হতে, হাতে ধরা শাল পাতার ঠোঙাটা দলা পাকিয়ে ফেলে  দিয়ে,গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ হাল্লাক হয়ে বসল সে। তারপর উদাস হয়ে আবার ভাবতে লাগল  নারী জীবনের অভিশাপের কথা। সেই যেদিন থেকে সে ডাগরটি হয়েছে পুরুষের দৃষ্টি তাকে বিরক্ত করে মারছে। বয়সের কোন বাছ বিচার নেই।সে যেন সকলেরই লালসার বস্তু, চলমান একটা খাদ্য বিশেষ। সবে তো তার উনিশ কি কুড়ি বছর বয়স। বাঁচতে হবে এখনও অনেক বছর। তা কি এই ভাবে ? বিয়েটাই কি একটা মেয়ের জীবনের শেষ কথা ? না হলে কি তাকে পদে পদে অপদস্ত হতে হবে ? একজন পুরুষ যদি এই সমাজের বুকে বিয়ে না করেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, তবে একটা মেয়েই বা তা পারবেনা কেন ? কেনই বা শুধু শুধু তার নামে বদনাম রটান হবে ? ঠিকই বলত  মা, সংসার বড় শক্ত ঠাঁই। এখানে একা এক মেয়ে মানুষের শান্তিতে বাঁচা দায়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে অন্যমনস্ক ভাবে হাত বাড়াল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী  খেলনা বেহালাটার দিকে। মায়ের যে প্রিয় গানটি মা মাঝে মঝে বাজাত,এই মুহূর্তে সেই গানের সুরটি ই  তার কানে বাজছে সে সেটাই বাজাতে লাগল-“উথালী পাথালী আমার বু.উ.উ..উ..ক,আ মা.আ আ র মুনেতে নাইসু.উ.উ..উ খ  রে।ও আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে......। অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে। একাকী বিষণ্ণা নারী  অতসী, নদী তীরে তার নিজের সৃষ্ট সুরের মূর্ছনায় সে নিজেই তন্ময় হয়ে হারিয়ে গেল তার আশেপাশে  কি যে  ঘটছে  তা নিয়ে তার কোন হুঁশই নেই। সম্বিত ফিরল বাঁশির সুরে। চমকে উঠে  মুখ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ওর সেই প্রিয় জায়গাটায় বসে এক যুবক ওর গানেরই সুরে বাঁশি  বাজাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাজনা থামিয়ে দিল। নারীর সহজাত বুদ্ধি বিবেচনা তাকে সাবধান করে দিল। আজ হাটবার, একশ একটা বাজে লোক ঘুরছে চেনা নেই শোনা নেই অচেনা এক ছোঁড়ার সঙ্গে সে নদীর পাড়ে গাছ  তলায় বসে  বাজনার যুগলবন্দী করছে। এই খবরটা চাউর হলে গাঁয়ে গাঁয়ে এক্ষুনি ডি ডি পড়ে যাবে।  কিছু না করেই যখন তার বদনাম রটছে,আর এটা একবার রটলে তো আর দেখতে হবে  না।  সে আর কাল বিলম্ব না করে উঠে পড়ল। ত্রস্ত পায়ে হাঁটা দিল হাটের পানে।অতসী বাজনা বন্ধ করার  সাথে সাথে যুবকটিও তার বাঁশি বাজান বন্ধ করে দিয়ে উঠে পড়েছিল, এবার অতসীকে উঠতে দেখে,   সে এগিয়ে এলো। কাছে এসে হেসে বলল –কোথায় বাড়ি গো তোমার ?বেড়ে হাত ত তোমার? মাত্তর  একটা মাটির খেলনা তুমি যে এতো সুন্দর করে বাজালে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বেস হতনা। কার কাছে শিখেছ?  অতসী গম্ভীর গলায় বিরক্তির সঙ্গে জবাব দিল আমার মায়ের কাছে।  সর দিকিনি বাপু, এবার আমায় যেতি দাও দেখি ? ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে। ছেলেটি তেমনি হেসে বললে- ঠিক আছে যাও। তবে আমি কিন্তু এগাঁয়ের লোক নই। নদীর জলে ভেসে এসেছি ওই যে দেখছ ওই  নৌকাটা, ওটাই আমার ঘরওতে চেপে আমি দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াই। যখন যেখানে ইচ্ছা হয়  দুএক মাস থাকি, তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি। এখন এখানে আমি ক’দিন এই গাছ তলাতেই  থাকব। সময় পেলে এসো, দেশবিদেশের গল্প শোনাব।আর তোমার ওই মাটির ব্যায়লাটাও সঙ্গে এনো। গান শুনব”। অতসী বললে-“ হুঁঃ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই  তোমায় গান শোনাতে আসি, সর তো বাপু ঢের কাজ পড়ে আছে,  যেতি দাও। অতসী হন হন করে হাঁটা দ্যে ফিরে এলে আবার  হাটে। এখানে সেখানে  দুএকটা দোকানে তোলা কিছু কাজ করে দিয়ে, নিজের বেচাকেনার জিনিষ আর আনাজপ্ত্র গুলো তার  ঝুড়িতে ঝোলায় ভোরে, সন্ধ্যার মুখে হাঁটা   দিলে গাঁয়ের পানে।                    

No comments:

Post a Comment