Monday, 6 June 2016

অভিমান

                                  অভিমান  

ভোর রাত্রে একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখে, ধড় মড় করে উঠে বসলেন রমাদেবী। খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ঢক ঢক করে এক ঘটি জল খেয়ে, সদ্য দেখা স্বপ্নটা মনে মনে ভাবতে লাগলেন। খুকী বলছে-“ মা আমি চললুম ওকে তোমরা কিছু বল না। নু সনু কে দেখ”। চললুম মানে? কোথায় চলল মেয়ে? অঘটন কিছু একটা ঘটেনি তো? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তাঁর বুকটা। তারপরই শুনলেন পাশের ঘরে ফোন বাজছে, কর্তার গলার আওয়াজ - হ্যালো, তারপর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। ফোন নামিয়ে রাখার শব্দটা ও এ ঘর থেকে শোনা গেলকিছুক্ষণ পর কর্তা আস্তে আস্তে সন্তুকে ডাকলেন –“ এই সন্তু ওঠ, এক্ষুনি একবার গোবিন্দপুর যেতে হবে”। আর থাকতে পারলেন না রমাদেবী, নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পাশের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে, কাঁপা কাঁপা উৎকণ্ঠিত স্বরে স্বামীকে  জিজ্ঞাসা করলেন-“কার ফোন? এতো  ভোরে কে ফোন করলে”?
-“ওই মদন,মদন ফোন করেছিল।বললে যে খুকীর শরীরটা খারাপ।একটু বাড়াবাড়ি  হয়েছে বোধ হয়, হাসপাতালে দিতে হবে্‌।তাই এখান থেকে কেউ গিয়ে নিয়ে এলে  ভাল হয়”।কর্তা কথা গুল বললেন খাটে বসে মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে চেয়ে। তিরিশ বছর ঘর করছেন তিনি তাঁর সঙ্গে, গলার স্বরেই বুঝতে পারেন মানুষটার মনের অবস্থা কী? তার উপর ঐ মাথা নীচু করে কথা বলা? নিশ্চই কিছু একটা হয়েছে, অথচ উনি লুকচ্ছেন। রমাদেবী সন্তুকে ডাকলেন-“সন্তু ওঠ, হাত মুখ ধুয়ে নে।চা করে দিচ্ছি খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়।দেখ সেখানে আবার কি হ’ল”?
চা খেয়ে ছেলে বেরিয়ে যেতেই রমাদেবী ভাবতে বসলেন।সত্যি কী যে হ’ল মেয়েটার? দিব্বি ভাল ছিল।ইস্কুলে ভাল রেজাল্ট করত। কিন্তু ইস্কুল যাওয়া আসার পথে পড়ে গেল ওই বাজে ছেলেটার খপ্পরে।তারপর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে বসল।বিয়ে যখন করেই ফেলেছে, তখন মেনে নিতে হ’ল। কিন্তু তারপর বিপদের উপর বিপদ।ছেলের না আছে চাল,না আছে চুলো। গ্রামে মাটির বাড়ি, অতি গরীব।এখানে মামাদের রেশন দোকানে মাল মাপার কর্মচারী। সেই মামাদের বাড়িতেই আশ্রিত।ফলে বাড়িতে এনে রাখতে হ’ল। শিক্ষাদীক্ষা ও নেই যে একটা চাকরী জুটিয়ে দেওয়া হবে।এদিকে বখাটে ছেলে, বন্ধু দের পরামর্শে নিত্য নতুন ফন্দী আঁটছেন আর ব্যবসার নামে পয়সা ওড়াচ্ছেন। কর্তা ছাপোষা মানুষরোজ রোজ কোথায় পাবেন অত টাকা।এর মধ্যে আবার দু দুটি ছেলে হয়েছে। তাদেরও খরচ আছে।এক দিন তাই বলতে বাধ্য হলেন-“এবার  তোমার নিজের রাস্থা তুমি নিজে দেখে নাও বাপু। আমি তোমায় আর টাকা দিতে পারবনা”।
পরের দিনই সে মুখ গোঁজ করে রাগ দেখিয়ে ছেলে বউ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেল।সেই সময়েই তাঁর মনে হয়েছিল যে কাজটা বোধহয় ঠিক হ’লনা।যে গোঁয়ার গোবিন্দ জামাই, কিছু না একটা করে বসে? মেয়ের মুখটা মনে পড়তে চোখ বস্পাচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাঁরমুখে আঁচল চাপা দিয়ে সবে একটু চোখের জল ফেলতে  যাবেন, ওমনি কর্তার হাঁক শুনলেন-“কৈ গো সকালের চা টা কি ভুলে গেলে নাকি”? তাই তো, মেয়ের কথা ভাবতে বসে কর্তাকে চা দেবার কথা ভুলে গেছেন। তাড়াতাড়ি এক কাপ চা করে তাঁকে দিতে গিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন-“খুকির কি হয়েছে বলতো?-“ কি আবার হবে? জমাইকে তো তুমি চেন, সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে এখন বউ ছেলে দের এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমিও এবার ঠিক করেছি খোরপোষ আদায় করে তবে ছাড়বএকটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা”?কিছুই বুঝতে পারলেন না রমা দেবী।অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন-“সন্তুটা যে কি?এখনও একটা ফোন করলে না।কি যে হচ্ছে ওখানে কে জানে?যাকগে ছেলেদের নিয়ে খুকি আসবে, তুমি তাড়াতাড়ি একবার বাজারে যাও”।
উনি বাজারে চলে যেতে রমাদেবী বাড়িতে একা।পায়ে পায়ে তিনি রান্না ঘরে এসে   ভাবতে বসলেন মেয়ের কথা, কি সুন্দর মিষ্টিই না ছিল মেয়েটা? যে দেখত সে বলত ‘রাজ রানী হবে তোমার মেয়ে’। সেই মেয়ের একি হাল হ’ল?মাস দুয়েক আগে ক’দিনের জন্য এসেছিল ছেলেদের নিয়ে।সারা গায়ে কালশিটে আর ছ্যাঁকা খাওয়া পোড়া দাগ।জিগ্যেস করতে বললে, রান্না করতে গিয়ে লেগেছে। ভাবনাটা আর বেশী এগুলনা। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হ’ল।ঠিকে ঝী লক্ষ্মী এল সকালে ঘর ঝাঁট দিতে।রমাদেবী চোখ মুছে দরজা খুলে তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে গেলেন।  এখনো সন্তর কিন্তু কোন খবর  নেই। ছেলেটা সেই গিয়ে থেকে একটা ফোনও করলে না।ঝী কাজ করে চলে যেতে বাড়িতে আবার তিনি একা।রান্না ঘরে  ভাবতে বসলেনশুধু একা মেয়ের দোষ দিলে হবে না, দোষ একটু তাঁর নিজেরও আছে।পাড়ায় কানাঘুষো শুনে তাঁর সাবধান হওয়া উচিত ছিল।“ সবই অদৃষ্ট”  বলে একটু চোখের জল ফেলতে যাবেন, কর্তা ফিরলেন বাজার করে।তাঁর হাত থেকে থলে দুটো নিয়ে রমাদেবী ঢুকলেন রান্না ঘরে।সবে আনাজ পত্র গুল গুছবেন, শুনলেন দুতলায় কর্তার ঘরে ফোন বাজছে। একরকম প্রায় ছুটেই তিনি উপস্থিত হলেন কর্তার ঘরের বাইরে। হাঁপাতে হাঁপাতে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলেন কথা বার্তা। দুবার হ্যালো হ্যালো করে রং নাম্বার বলে ফোন রেখে দিলেন কর্তা।আর ঠিক সেই সময়েই একটা ভারী গাড়ি এসে থামল সদর দরজার সামনে।বল হরি,হরি বো্‌ল, বলে রব উঠল দোর গোড়ায়।বুকটা কেঁপে উঠল   তাঁরদুতলার বারাণ্ডা থেকে দেখলেন যে, লরিটা থেকে সন্তুর হাত ধরে নামছে সনু  অনু।আর খুকীর নিথর মরদেহ ফুলের শজ্যায় শুয়ে আছে লরির উপরে।গালে  কপালে চন্দনের ফোঁটা, সিঁথিতে লাল সিঁদুর।আর দেখতে পারলেন না তিনি, ছিটকে ঘরে ঢুকে শজ্যা নিলেন। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কাঁদতে যাবেন, ঠিক সেই সময় সনু অনু ঘরে ঢুকে আছড়ে পড়ল তাঁর উপর-“ ও দিদু খুব খিদে পেয়েছে, খেতে  দাও না গো”।অবোধ শিশু দুটির একটির বয়স পাঁচ, অন্যটির  তিন।তারা এখনও জানেনা যে জন্মের মতো তারা কি হারিয়েছে? চোখ মুছে   উঠে বসলেন তিনি। গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরলেন ওদের।মেয়ের শেষ স্মৃতিআহা সকাল থেকে বোধহয় খাওয়া হয়নি বাছাদের। মুখ দুটি শুকিয়ে আমশি  হয়ে গেছে।যাদের মা চলে গেছে, তাদের আর কেই বা আছে?কে যত্ন করবে,কে ডেকে দুটি খেতে দেবে?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বললেন-“এদের তো এখন আমাকেই দেখতে হবে”।বচ্ছা দুটিকে নিয়ে নীচে রান্না ঘরে ঢুকতে যাবেন, পথ আটকে দাঁড়াল  ক্যামেরা কাঁধে কয়েকটা ছেলে মেয়ে।–“যিনি মারা গেছেন আপনি নিশ্চই তার মা,  আর এরা তার ছেলে?বলুন ম্যাডাম কি হয়েছিল"?-“আমি কিছু জানিনা” বলে ছেলেদের নিয়ে কোন রকমে সেখান থেকে পালিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন রান্না ঘরে।তারপর  দুধ গরম করে খেতে দিলেন ওদের।সন্তুকে ডেকে জানতে ইচ্ছা  করছে, যে কি হয়ে ছিল? কিন্তু বাড়িতে এক গাদা বাইরের লোক গিজ গিজ করছে।পুলিশের লোকও এসেছে।এর মধ্যে কোথায় সন্তু? কার কাছেই বা তিনি জানবেন? কারই বা দায় পড়েছে তাঁকে কিছু জানাতে? শব্দ করে হরি ধ্বনি করতে করতে মেয়েটাকে নিয়ে লরিটা চলে গেল। বাচ্ছা দুটিকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরের এক কোনে কাঠ হয়ে বসে রইলেন তিনিশোকে পাথর হয়ে গেছেন।চোখের জল ও সুকিয়ে গেছে।সদর দরজা খোলাই ছিল, লক্ষ্মী ভিড় ঠেলে ঢুকে সারা বাড়ি দেখে, শেষে রান্না ঘরে খুঁজে পেল গিন্নিমাকে।গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞাসা  করল–“হ্যাঁ মা কি হয়েছিল  খুকী দিদিমণির”? 
খানিক্ষন বোবা দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে থেকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গভীর দুঃখের সঙ্গে তিনি বললেন -“তোকে আর কি বলব লক্ষ্মী ,সবই আমার কপাল আমার অদৃষ্ট। না হলে কি আর এমন হয়? সবার সব কিছু থাকল শুধু আমার মেয়েটাই চলে গেল”।এই পর্যন্ত বলে তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।লক্ষ্মী তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললে –“কেঁদনি মা, যে যাবার সে তো গেছে।কাঁদলে তো আর ফিরবেনি”। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি বলে চললেন –“ কাঁদতে দেরে আমায় একটু চোখের জল ফেলতে দে মা?সেই সকাল থেকেই মনটা আমার আনচান করছে, তবু কেউ আমায় কিছু বলছে না।বলি মেয়েটা তো আমার, আমি তো তাকে দশ মাস পেটে ধরেছি, বুকের দুধ খাইয়ে কোলে পিঠে মানুষ করেছি।আজ সে যখন আমায় ছেড়ে চলে গেল,  কেউ আমায় সে খবরটা পর্যন্ত দিলে না।এই খবরের জন্য আমি ভোর থেকে পথ চেয়ে বসে আছি, অথচ আমায় কেউ কিছু জানাল না।আমি মা। মরা মেয়েটার মুখটা ভেবে যে একটু শোক করব, তার সময়ই পাচ্ছি না।হে ঈশ্বর তোমার এই বিশাল পৃথিবী তে কি একটু শোক করার জায়গা নেই? একজন সদ্য সন্তান হারা মা কি নিভৃতে একটু চোখের জল ফেলতে পারবে না”?                                                                                                
 
তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২২ শে জ্যৈষ্ঠ ১৮২৩                                      

1 comment:

  1. a mother always gives preference to her duties n responsibilities than her grief ...this feeling is always true to all woman who belong to any background of the society- this story portrays it perfectly.

    ReplyDelete