Friday, 10 June 2016

বলি

“বলি ছাগল কিনতে এসেছ না কনে দেখতে এসেছ?  
তখন থেকে এমন নেড়ে চেড়ে দেখছ যেন বিয়ে করবে”?    
“তা কি করব বল মাসি?বলির পাঁঠা বলে কতা, তা একটু দেখেশুনে নিতে হবে না? খুঁত থাকলে কি চলে”?       
দু বাড়ি কাজ সেরে ঘরে ফিরছিল ছবি।বস্তীর মুখে ছাগল মাসির ঘর থেকে ভেসে আসা কথা গুল শুনে হাসি পেল তার।-তা বলেছে মন্দ নয়। বিয়ের কনে আর বলির পাঁঠা তো প্রায় একইযে পাঁঠাটিকে কাল বলি দিয়ে তার মাংস খাওয়া হবে, তার শরীরে কোন খুঁৎ থাকা চলবে না। যে  মেয়েটিকে সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে গিয়ে, সংসারের হাড়ি কাঠে বলি দিয়ে তাকে দিয়ে হাঁড়ি ঠেলান  আর বাচ্ছা বানানর কল বানান হবে, তার  শরীরেও কোন খুঁৎ থাকা তো চলবেই না, এমন কি গায়ের রঙ কালো বা নাক চোখ ছোট হলেও  চলবে না। আবার লেখাপড়া ও জানা চাই।তফাত শুধু একটাই, পাঁঠা যতো কালো হবে তার দাম ততো বেশি হবে।কনে যতো কালো হবে তার দাম ততো কম হবে।
আজ প্রায় বছর পাঁচেক হ’ল ওর বিয়ের কথা চলছে। পাত্র পক্ষ দেখতে  এলে ওকে সেজে গুজে ঘাড় গুঁজে বসতে হচ্ছেআর চার ছ’ জোড়া চোক্ষু ওকে তারিয়ে তারিয়ে গিলছেপ্রথম প্রথম কয়েক জায়গায় কথাবার্তা একটু    এগিয়েও ছিল, তবে ছবির কিন্তু কাউকেই তেমন মনে ধরেনিপাশের ঘরের ওই সন্ধ্যাদি কে দেখ, কেমন সুন্দর বে হয়েছে। বর ব্যাঙ্কে চাকরি করে।সন্ধ্যাদিকে কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে হ্যাঁরে সন্ধ্যা, তোর বর কি করে রে? সন্ধ্যাদি অমনি এস্টাইল করে ঘাড় দুলিয়ে বলে- ও তো ব্যাঙ্কে আছে।এঘর সে ঘরের কেউ কেউ অবশ্য বলে যে ব্যাঙ্ক না হাতি?“করে ত এটিএম ঘরের দারওয়ান গিরী”তার আবার ঢঙ দেখ”? সে যাইহোক,  ছেলেটা শিক্ষিত তো বটেশুনেছে একটা পাশনাকি দিয়েছে।এদের মতো অশিক্ষিত নেশাখোর জুয়াড়ি তো নয়।মনে মনে এরকমই একটা বর চাইছে সে ইস্কুলের বা হাসপাতালের ফোরথ কেলাস স্টাফ হলেও্ চলবে।   
তখন ও বেশ সন্ধ্যাদির মতো এস্টাইল করে ঘাড় দুলিয়ে বলবে যে ও তো ইস্কুলে আছে, বা হাসপাতালে আছে।কিন্তু আসছে সব ওলার দল।কেউ রিক্সাওলা কেউ ভ্যান ওলা কেউ বা  ফেরিওলা।
একদিন কিন্তু ওদের অবস্থা ভালই ছিল।তখন ও কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেনি  যে মায়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বাবুদের বাড়ি কাজ করতে হবে। এঁটো থালা বাসন মাঝতে হবে উলটে ওর যখন ছোট ভাই টা হয়, তখন মাকে ভাইকে দেখার জন্যে  লোক রাখা হয়েছিল।সে আজ অনেক বছরের কথা। বাবা তখন কাজ করত চটকলে। থাকত গঙ্গার ধারে একটা ভাড়া বাড়িতে।আত্মীয় স্বজন বাবার বন্ধুবান্ধব, অনেক লোকজন যাওয়া আসা করত ওদের বাড়িতেছোট্ট ছবি ইস্কুলে যেত মায়ের হাত ধরে। তারপর কোথা থেকে যে  কি সব হয়ে গেল? চটকলে ধর্মঘট মারামারি হ’ল।পুলিশ এসে অনেক কে ধরে নিয়ে গেল কিন্তু জেল হ’ল ওর বাবারই। প্রথম প্রথম ইউনিয়নের লোকজনেরা কিছু সাহায্য করলেও পরে আর তাদের  টিকি দেখা যায়নি। আত্মীয় স্বজনেরা ও কেউ দাঁড়াল না। তখন বাধ্য হয়েই ওর মা ওদের নিয়ে এই বস্তি তে চলে এলআর  তারপর শুরু হল ওদের কষ্টের জীবন। কথায় কথায় অভাব।আর এমন অভাব  যে পেটে টান পড়ে যায়। ভাই টা তার তখন  ছোট খিদের জ্বালায় কাঁদত।    এরপর ওর বাবা যখন ছাড়া পেল, ওরা বুঝল যে সরকারি সংশোধনাগার    তাকে বিশেষ সংশোধন করতে পারেনি।বরং আগে তার যে দোষ গুলো ছিল  তার সঙ্গে এখন আরও কয়েকটা যোগ হয়েছে। সেখান থেকে ফিরে প্রথম কয়েক দিন সে গুম মেরে বাড়ীতে বসেছিল। তারপর স্বমূরতি ধরলযে কটা টাকা নিয়ে সে জেল থেকে বেরিয়ে ছিল তা নেশা ভাং করে, জুয়া খেলে ওড়াল, তারপর টাকার জন্যে ঘরে অত্যাচার শুরু করল। আশপাশের ঘরের লোকেরা হাসাহাসি শুরু করল, আর লজ্যায় ওদের মাথা নীচু হয়ে গেল।এরপর টাকার জন্যে তার বাবা রিক্সা টানা শুরু করল।
এক দিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে ঘরে ঢোকার মুখে ছবি শুনেছিল বাবা মায়ে কথা হচ্ছে, মা বললে-“ ছবি কি পারবে মানিয়ে নিতে? সেখানে যে শুনলুম এখনও নাকি কারেন্টই যায়নি। নাকি হ্যারিকেন  জ্বালতে হয়”।বাবা বললে ওসব থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে যাবে। তাই বলে কি অমন ভাল পাত্রটা হাত ছাড়া করা যায়? দেশে তাদের নিজেদের বাড়ি ঘরদোর বিষয় আসয় বাগান  পুকুর আছে।ছেলের আবার নিজের মাছের ব্যবসা।এরা  লোক ও ভাল।দেনা পাওনাও তেমন নেই। একটু লেখা পড়া জানা মেয়ে চাইছে। পছন্ধ হ’লে তারা  নিজেরাই সাজিইয়ে গুছিয়ে নিয়ে যাবে”এই পর্যন্ত শুনেই ঘরের বাইরে দাঁড়ীয়ে পড়েছিল ছবি।নিশ্চই নতুন কোন সম্বন্ধ এসেছে? ব্যাস ওকে আর পায় কে? দাঁড়ীয়ে দাঁড়ীয়েই ভাবতে লাগল-“একটু লেখা পড়া তো সে জানেই তাছাড়া  দেখতে ও তাকে ভালই, সুতরাং পছন্দ তাদের নিশ্চই হবে।আর একবার পছন্দ হওয়া মানেই বিয়ের পরে গ্রাম দেশে গিয়ে থাকা।ব্যপারটা ঠিক মনঃপূত হ’ল না ওরতবে কি আর করা যা্বে? বিয়ের পর মেয়েদের তো শ্বশুর ঘর করতেই হয়।তাই যেতেই যদি হয় তো সে যাবে।ওর মনে পড়ল অনেক দিন আগে ওদের পাড়ারই একটা মেয়ের গাঁয়ে বিয়ে হয়ে ছিল।তার কাছে শোনা গল্পের সূত্রে, ছবি স্বপ্ন দেখতে লাগল-  গাঁয়ের কাঁচা বাড়ি মাটীর ঘর, খড়ের  চাল। তা হ’ক, ভাড়ার তো নয়, নিজেদেরই বাড়ি। কলঘর নেই,পুকুরে নাইতে হ’বে। তারপর নেয়ে উঠে কলসি কাঁকে ভিজে কাপড়ে, এক গলা ঘোমটা টেনে ঘোমটার খুঁট দাঁতে টেনে, খালি পায়ে খালি গায়ে আম বাগানের ছায়া ঘন মেঠো পথ ধরে ঘরে ফিরবে সে। নিজের অজান্তে গানের একটা কলি ও গেয়ে ফেল্ল - “কে তুমি ললনা? যৌবন ধন্যা সিক্ত বসনা” ফিক করে সলজ্জ একটা হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটের কোণে।কিছুই যেন জানেনা বা শনেনি, এমনি ভাব করে ঘরে ঢুকে ছিল ওকিন্তু কোথায় গেল সেই ছায়া ঘন আম্র কুঞ্জের মিষ্টি মেঠো পথ? আজও তাকে মাড়িয়ে বেড়াতে হচ্ছে দুরগন্ধ ময় নোংরা নর্দমার  জলে ভরা বস্তির রাস্তা। ওর সেই স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল।বাস্তব হল না কোন দিনইকোন দাবি দাওয়া নেই বললে কি হয়? একটা সোনার আঙটি আর সাইকেল চেয়ে ছিল তারা। অতকিছু কোথায় পাবে ওরা? ছবির বাবা বলছিল হয় আংটি না হয় সাইকেল দেব ।কিন্তু আরেক জনেরা, যাদের ওই রাস্তার ওপর চায়ের দোকান, তারা শুধু সাইকেল সোনার আংটিই নয় সঙ্গে একটা পাঁচ ব্যাটারির টেপা বাতি দিয়ে ছেলেটাকে ভাঙিয়ে নিলে বিয়ে আর স্বপনটা একই সঙ্গে একই দিনে ভেঙ্গে গেল তার।যাকগে ভাগ্যিস সে বিয়ের কথায় কাজ গুল ছেড়ে দেয়নি? কি যে হ’ত তা হ’লে? আসলে ওই পরের বাড়ি কাজ করাটাই কাল হয়েছে।যার যা খুশী বলে বেড়ায়        
এদিকে বিয়ে বিয়ে করে ওর মা পাগল।কিন্তু কিছুতেই ঠিক মতো লাগছে না।  বিরক্ত হয়ে মা ওকে বলে- “আজকাল সব মেয়েরাই নিজে নিজে ধরে  নিচ্ছে।তুই পারিস না”?ছবি কিন্তু সত্যিই পারছেনাএকে তো এখানকার কোন  ছেলেকেই ও পছন্দ করেনা। তার উপর শ্যামলদা কে কোন দিনই ও ভুলতে পারবেনাহোক সে বাজে ছেলে, তবু সেই প্রথম ওকে স্বপ্ন দেখিয়ে  ছিল।সেই ওর কষ্ট বুঝেছিল।তারপর থেকে কাউকেই ও ঠিক বিশ্বাস করে  উঠতে পারে না। মা কে তাই বলে - “কেন মিছে তুমি আমার বিয়ে দিচ্ছ মা?বিয়ে মানেই তো সেই, না খেয়ে না দেয়ে কোলে কাঁকে বাচ্চা নিয়ে বাবুর বাড়ি বাসন মেজে  সংসার চালাওআবার সন্ধ্যা বেলা ঘরে ফিরে পিঠে মরদের কিল খাও
পান থেকে চুন খসলে শাশুড়ির মুখ নাড়া শোনাতারপর ক’দিন পরে ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এসে বসবা খাতায় নাম লিখিয়ে লাইনে গিয়ে দাঁড়াও তার থেকে এই বেশ আছি নিজে কামাচ্ছি নিজেখাচ্ছি    
 
তবু সেই ছবির ও একদিন বিয়ে হ’ল, পরিস্থিতির চাপে এবং নিজের অমতে।  ওকে যখন সাজিয়ে গুজিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে, কালীঘাটের পথ ধরে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ও দেখল যে ওর পাশে পাশে সেজেগুজে নিবিষ্ট মনে কাঁঠাল পাতা  চিবুতে চিবুতে একটা পাঁঠা ও চলেছে মন্দিরের দিকে, একই উদ্দেশ্যে, বলি হ’তে। তফাৎটা শুধু পাঁঠা চলে ছে না বুঝে, আর ছবি চলেছে জেনেবুঝে।  
সংসারে আমরা বলি হচ্ছি সবাই। কেউ বুঝে, কেউবা না বুঝে।  

তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়     
১.১.২০১৬  


1 comment:

  1. golpo ta khub sundoor kore samajh e meyeder osahaye obostha futiye tuleche...now marriage is not more bonding bt bondage

    ReplyDelete