Friday, 10 June 2016

বকুনি

বকুনি’ ( রম্যরচনা )        
                      
-“আচ্ছা বাবু আমি কি আপনার কোন ক্ষেতি করিচি”? ধূমায়িত চায়ের পেয়ালাটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা করল চায়ের দোকানদারসক্কাল বেলা এমন অদ্ভূত একটা প্রশ্ন শুনে হরিবাবু যারপরনাই চমকালেন। এমনই চমকালেন  যে ফুটন্ত  গরম খানিকটা চা, পেয়ালা থেকে চলকে তাঁর কাপড়ে পড়ে গেল। আর একটু হলে গোটা কাপটাই হয়তো পড়ে যেত। তিনবার  খাবি খেয়ে তিনি বললেন –“কৈ না তো”?
-“তাহলে আপনি আমার এমন ক্ষেতিটা করতেছেন কেন”?   
-“আমি আবার তোমার কি ক্ষতি করলাম হে”?
-“বিশেষ কিছু না। তবে দোকানটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন তো। আপনি ছাড়া আর কোণ খদ্দের আছে কী”?
হরি বাবু চারি দিকে ঘুরে ফিরে দেখলেন যে কথাটা সত্যি। তিনি ছাড়া দোকানে আর কোন খদ্দের নেই। একটু অবাক হয়ে বললেন
–“ তা তারা সব গেল কোথায় ”?  
-“ কোথায় আবার ? ওই দেখুন না রাস্তার ওপারের চায়ের দোকানে সব চা খাচ্ছে, আড্ডা মারছে”।   
-“কিন্তু এপার ছেড়ে ওপারে চা খেতে গেল কেন”?
-“গ্যাছে কি আর এমনি? বকুনির ঠ্যালায় সব পালিয়েছে  
-“ কে বোকল ওদের”।
-“ আঁজ্ঞে আপনি”।
-“সে কি? আমি আবার কখন বকলাম”?   
-“সব সময়ই তো বকতেছেন তার কি আর সময় অসময় আছে ? আর একবার শুরু করলি কি আর থামা থামি আছে”?     
এই পর্যন্ত শুনেই হরি বাবু বাকিটা বুঝেগেলেন। রাগতঃ স্বরে বললেন।
-“ বুঝেছি, আর বলতে হবেনা। নিজের ভেবে দুটো জ্ঞানের কথা বলা, ভাল দুটো উপদেশ পরামর্শ দেওয়া। তা ভাল লাগবে কেন? এ জগতে কারো ভাল করতে নেই বুঝেছ”?   
 দোকানদার বললে-“ আর কেউ না বুঝুক আপনি যে এটা বুইয়েছেন, তাতেই আমার অনেক উবগার হ’লহরি বাবু আধ খাওয়া কাপটা ঠক্ করে টেবিলের উপর রেখে দোকান থেকে রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে শুনলেন দোকানদার বলছে
– “ওরা আপনার নাম দিয়েছে বক্তিয়ার খিলজী”। 

তবে এটা কিন্তু মানতেই হবে যে ভাল বকতে পারাটাও একটা আর্ট ।আর বিশেষ প্রতিভা না থাকলে সামান্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বা অনেক সময় সেরকম কোন বিষয় হাতের কাছে না পেলে ও, তৎক্ষণাৎ আলিক কল্পনার জাল বুনে, তার উপর প্রাসাদ গড়ে, হাত পা নেড়ে ক্রমাগত বকে বকে শ্রোতাদের মনোযোগ ধরে রাখাটা  বেশ শক্ত কাজ এ প্রতিভা আবার যার তার কপালে জোটে না। নামকরা বকিয়েরা সব বেশীর ভাগই এ ক্ষমতাটা পেয়ে থাকেন উত্তরাধিকার সূত্রেহরি বাবুর পিতামহ ঁরাধামাধব কীর্তনিয়া সে যুগের একজন নামকরা কীর্তন গাইয়ে  ছিলেন। কিন্তু গানের ফাঁকে ফাঁকে রাধা কৃষ্ণের লিলা বর্ণনা করতে গিয়ে, তিনি এমন বকবক জুড়ে  দিতেন যে, শ্রোতারা উঠে পালাত।আর সহ গায়ক ও বাজিয়ের দল খেই হারিয়ে গান বাজনা থামিয়ে বোকার মতো বসে থাকততাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাপদ বাবু, পিতার নাম রাখতে গিয়ে রেলের কামরায় একাই এমন বকবক জুড়ে দিতেন, যে পরের ইষ্টিশনে গাড়ি থামা মাত্র লোকে উরধশ্বাসে পালিয়ে বাঁচত। দু একজন যারা বসে থাকত, তারা হয় বদ্ধ কালা নয় উন্মাদ। সে কামরায় ভুলেও কোন হকার উঠত না। কিন্ত এ যুগে একে তো মানুষের হাতে সময় কম, তার উপর আবার শ্রোতার থেকে বক্তার সংখ্যা বেশী। ফলে বেশীর ভাগ সময়েই এই ফ্রীলেন্স বকিয়েরা শ্রোতা খুঁজে পান না।tara তারাপদ দাস মহাশয় পরিণত বয়সে সজ্ঞানে বকে বকে যখন বুকের ব্যথায় মারা যান, তখন গ্রামের  লোকে ভেবে ছিল যে এবার বুঝি গ্রাম খানা নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। পরিযায়ী পাখী থেকে শুরু করে কাক চিলেরা আবার বাসায় ফিরতে শুরু করবে(তারা সব তারাপদ বাবুর বকুনিতে গ্রাম ছেড়ে উড়ে পালিয়েছিল)কিন্তু হরিপদ বাবুর বকুনির ঠ্যালায় যেদিন একটা রাম ছাগল আর একটা আধ দামড়া গরু খোঁটা উপড়ে দৌড় মারলে, সে দিন প্রমান হল যে তিনি যথার্থই তাঁর পরলোকগত পিতা ঁশ্রী তারাপদ দাস মহাশয়ের সুযোগ্য পুত্র কেউ কেউ আবার বলেন যে, হরিপদ বাবু নাকি তাদের বংশের শ্রেষ্ঠ বকিয়ে।বকুনিতে তিনি তাঁর বাপ ঠাকুরদাকেও ছাড়িয়ে গ্যাছেন। শোনা যায় যে প্রথম জীবনে হরিবাবু যে সব জায়গায় কাজ করেছিলেন, সেখানে তাঁর বকুনির ঠ্যালায় কয়েক জন  সহকর্মীর স্নায়ু রোগ আর মাথার ব্যামো হয়েছিল। আর তাই দেখে বাকীরা সব পালাই পালাই করছিল। সেটা ছিল সাহেবদের আমল চাকরীর জন্যে বিশেষ চেষ্টা করতে হতনাইয়েস নো ভেরি গুড বলতে পারলেই মোটামুটি একটা চাকরী জুটে যেত।কিন্তু হরি বাবুর বকুনির চোটে লোক পালাতে শুরু করলে, সেটা সাহেবদের ও চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াল। তাঁর বকুনি থামানর জন্য শেষে সাহেবরা মিটিং ডাকলেন। এবং বড় সাহেব বলিলেন যে উহাকে আর আপিস ঘরে না রাখিয়া আউট ডোর সেলস এ পাঠাইয়া দাওসাহেবের বুদ্ধিতে সাপ ও মরল লাঠিও ভাঙল না। মনের মতো বকুনির জায়গা পেয়ে পূর্ণ উদ্যমে হরি বাবু কাজে লেগে গেলেন। প্রথম প্রথম তাঁর আগ ডুম বাগ ডুম  বকুনির জ্বালায় কিছু খদ্দের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলে ও, পরে্ সেলসের কাজে তাঁর খুব নাম হয় নিন্দুকেরা অবশ্য বলে যে লোকে নাকি তাঁর বকুনির হাত থেকে বাঁচতে, তাড়াতাড়ি কটা পলিসি কিনে তাঁকে বিদেয়  করে দিত তিনি কিন্তু সে সব দিনের কথা এখনও সুযোগ পেলেই জাঁক করে বলে বেড়ান। তবে সে রামও নেই,  রামরাজত্ব ও নেই। কথা বলে আর আগের মতো সুখ পাওয়া যায়না।তার উপর আবার ডাক্তারের উপদেশ –“হরি বাবু বয়স তো অনেক হ’ল, এবার কথা বার্তা একটু কমালে হয়না? হার্টে যে চাপ পড়ছে”।উনি বলেন “ডাক্তারবাবু   মনের সুখে যদি দুটো কথাই না বলতে পারলাম তাহলে আর বেঁচে লাভ কি”? এখান থেকেই বঝা যায় যে বকুনিটা তাঁর কাছে কেমন প্রাণাধিক প্রিয় বিষয় ছিল প্রানে যথেষ্ট ৎসাহ ও শক্তি, এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে ছবি গড়া ও তা অভিনয় সহকারে  বলবার  আসাধরন ক্ষমতা না থাকলে মানুষ এমন আন্তরিকতার  সঙ্গে অনর্গল  বকে যেতে পারে না।                                                                

চায়ের দোকান থেকে হনহন করে বাড়ি ফিরে এসে তিনি বৈঠক খানায় বসে গম্ভীরভাবে স্বগতোক্তি করলেন –“ নাঃ দিন কাল ভীষণ ভাবে পাল্টে গেছে। বলে কিনা বক্তিয়ার খিলজী? মরুগগে যাক, আমার আর কী থাকবি সব গোমুখখু হয়ে”। তারপর সবে তিনি একটু উদাস হয়ে পুরন দিনের কথা ভাবতে বসেছেন, এমন সময় দরজায়    প্রচণ্ড জোরে কড়া নাড়ার শব্দ হ’ল। এবং সেই সঙ্গে একটা মিনমিনে গলায় কে একজন  বললে “ভিতরে আসতে  পারি কি ? মে আই  কাম ইন ছ্যার”? অসভ্যের মতো জোরে জোরে কড়া নাড়া এবং তারপরে ওই মিনমিনে গলায় ছ্যার বলা। এ দুটোই হরি বাবুর ভীষণ অপছন্দতাই প্রচণ্ড  বিরক্তির সঙ্গে প্রথমে তিনি  হাঁকলেন-“কে ?” তারপর বললেন-“ দরজার  বাইরে জুতোটা খুলে আসবেন”যে আজ্ঞে বলে, টাক মাথা মাঝারি উচ্চতার একটি লোক,  আকর্ণ  দন্ত বিকশিত করে অ্যাটাচি হাতে ঢোলা একটা হাফ  শার্টের উপর সরু টাই পরে  ঘরে ঢুকল তাকে  আপদ মস্তক নিরীক্ষণ করে তিনি বুঝলেন যে লোকটি একজন  সেলস ম্যান।সকালে চায়ের  দোকানের  ঘটনাটায় মনটা  খিচড়ে ছিল, এবারে সেটা খনিকটা মেকাপ হবে।  ঈশ্বরের দান, একেবারে বাড়ি বয়ে এসেছে। এখন ঝাড়া একটি ঘণ্টা নিশ্চিন্ত মনে বকে যাওয়া যাবে। লোকটিকে একটা চেয়ারে বসতে  বলে বিনা ভূমিকায় তিনি শুরু করলেন -“ দেখ ওয়ারক ইজ ওয়ারশিপ। কোন কাজকেই ছোট মনে করবেনা”। লোকটি হাঁ করে শুনতে শুনতে বলে উঠল-“ ঠিক ঠিক একদম ঠিক। আমার এক দাদা নেভীর ওয়ারশিপে ওয়ারক করে। সেও তাই বলে”। হরি বাবু তার কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মনেই বলে চললেন-“ আমি যখন সেলসে ছিলুম, খুব ভরে উঠে দুর্গা দুর্গা  বলে কাজে বেরিয়ে পড়তুম”।  ওনার কথার মাঝেই  লোকটি বলে উঠল-“ আমিও তাই করি ছ্যার, ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ি। আজ ও   আমার  আর  একটু সকাল সকাল বেরুনর  ইচ্ছা ছিল। কিন্তু  যেই বেরুতে যাব বৌ বললে –“ পাঁজি দেখনি ?  সকাল দশটা  পর্যন্ত  বার বেলা আর উত্তরে যাত্রা  নাস্তি” আমার বাড়িটা আবার  আপনার বাড়ির ঠিক দক্ষিণে কিনা ? তারপর আপনার বৌমা আবার বললে যে  ওনার  কাছে  যখন যাচ্ছ, কিছু খেয়েদেয়ে যাও শুনতে পাই উনি একবার বকতে শুরু করলে কবে যে  থামবেন তার  ঠিক ঠিকানা নেই। তাই  কুমড়োর ছক্কা দিয়ে চাট্টি ভাত  খেয়েই বের হলাম। পাঁজিতে যদিও আজ অকাল  কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল,  তবে আমার ওই কুমড়োটা পচে যাচ্ছিল কিনা”? এনাফ ইজ এনাফ, ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গল হরি বাবুর। চীৎকার করে উঠলেন-“ তোমার বাজে বকাটা থামিয়ে কাজের কথা কিছু বলবে ? নাকি সারাদিন শুধু ফালতু বকেই যাবে”? লোকটি সহাস্যে বলল- “ও একটু বেশী বকে ফেলেছি না ? আসলে যারা নিজেরা  বকতে ভালবাসেন, তারা অন্যের বকুনি সহ্য করতে পারেন না”।  হরি বাবু বললেন –“ দেখ ছোকরা গুছিয়ে কাজের   কথা বলা আর বক বক করা এক কথা নয়।  নাও বল দেখি এবার কেন এসেছ”? লোকটি তার ব্যাগ থেকে একটা হলুদ রঙের কাগজ বের করতে করতে বললে-“ আমাদের বীমা কম্পানি ছ্যার আপনাদের মতো বুড়োহাবড়া মায়  ঘাটের... থুড়ি সরি, সিনিয়ার ছিটিজেন দের জন্যে নতুন কয়েকটা পলিসি লঞ্চ করেছে। এতে আপনি  একবার মাত্র  টাকা জমা করবেন, আর আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে আমরা  লামসাম টাকার  বাণ্ডিল আপনার হাতে দিয়ে দেব”
-“আর আমি সেটা হাতে নিয়ে সোজা একেবারে স্বর্গে চলে যাব”।এই বলে হরি বাবু কটমট করে তার দিকে   তাকিয়ে বললেন-“ তোমার কাছে আমি কোন পলিসিই করাব না।  দয়া করে এবার তুমি এস”। লোকটি ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে উঠতে দন্ত বিকশিত করে  বললে-“ আমি তাহলে কবে নাগাদ আবার আসব ছ্যার”?  হরি বাবু বললেন-“ অনেক হয়েছে আর  আসার দরকার নেই”।   
-“ সে কী ছ্যার এত করে পাঁজি দেখে...............”?
-“ শুধু পাঁজি কেন? তুমি গুষ্টির কুষ্ঠী মিলিয়ে বের হলেও কাজ হত না” 
লোকটি বেরিয়ে যেতে হরি বাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে  ভাবলেন যে আজ দিনটাই খারাপ। সত্যি, সে সব কি দিনই  ছিল, আর এখন কি হয়েছে।  

কিছুক্ষণ পর দরজায় আবার কে একজন খুব আস্তে আস্তে কড়া নাড়ল। তারপর বাইরে থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল –“ভেতরে আসতে পারি”?   
হরি বাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন -“হ্যাঁ হ্যাঁ”ঘরে ঢুকল বছর পঁচিশের একহারা রোগা একটা ছেলে। হাতে একটা  ফোলিয় ব্যাগ।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকে সে পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দরজার দিকে তাকাল।   
তার দিকে তাকিয়েই হরি বাবু বুঝলেন যে এও তাঁর লাইনেরই লোক অর্থা সেলসের।  একটু  আগের ওই বাজে  সেলস ম্যানটার বাজে বকুনি শুনে  হরি বাবু মনে মনে খুব বিরক্ত ছিলেনকিন্তু এই ছেলেটিকে তাঁর বেশ ভাল  লাগল। তাকে মুখমুখি একটা  চেয়ারে বসতে বললেন। ছেলেটি ভীষণ জড়সড় ও আড়ষ্ট ভাবে চেয়ারে বসে, খুব ভয়ে ভয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা বলতে গিয়ে ঢোক গিলল।তারপর দুবার কেশে খুব করুন চোখে তাঁর দিকে চেয়ে, ততোধিক করুণ স্বরে বলল-“ একটু জল”হরি বাবু এতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে হাসছিলেন আর ভাবছিলেন “ বাপু হে এই যদি তোমার পার্টি মিটিং এর ধরন হয়, তাহলে এ লাইনে তোমার আয়ু আর খুব বেশী দিনের নয়। তবে ওই পাঁজি ওলা আকাল কুষ্মাণ্ডুর থেকে ভাল। সেই সঙ্গে ছেলেটির  প্রতি তাঁর একটু অনুকম্পা ও হ’ল।“আহা বেচারি নিশ্চই লাইনে নূতন।এখনও ভালভাবে  কাজকর্ম তেমন শিখে উঠতে পারেনি। চিন্তা নেই এক দিনেই শিখিয়ে দেব” ছেলেটি জল খেতে খেতে যখন জুলজুল করে তাঁর দিকে তাকাচ্ছিল, তিনি শুরু করলেন –“শোন কর্মক্ষেত্রে বাঙালীর সব থেকে বড় ড্র ব্যাক হ’ল, জড়তা।পলেটিক্স বল, ইষ্ট বেঙ্গল মোহনবাগানের ম্যাচ বল, তখন মুখে একেবারে খই ফুটছে। যেই না কাজের কথা উঠল ওমনি স্পিক টি নটএরকম আড়ষ্ট ভাবে পারটি মিট করলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে না। এই পর্যন্ত শুনে ছেলেটি তার ব্যাগের দিকে হাত বাড়াতে, হরি বাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন।বললেন –“ এই তোমাদের এক মস্ত বড় দোষ, সব ব্যাপারে তাড়া হুড় কর।কথাটা আগে শেষ করতে দেবে তো”? ছেলেটি বলতে গেল-“ না মানে জ্যেঠু এই বলছিলাম কি আমার একটা টার্গেটের ব্যাপার আছে কি না”?-“এই দেখ, কথায় কথায় খেজুরে আলাপ, আত্মীয়তা সৃষ্টি্‌র চেষ্টা, এ সব হাইলি আনপ্রফেশনল। নো কাকা জ্যাঠা, নো কাকিমা মাসিমাকল ইয়োর ক্লায়েন্ট এ্যাজ স্যার অর ম্যাডাম।আর শোন তুমি হ’লে সেলস ম্যান, ভিখারী নও।এই কাজটা হ’লে তোমার কি উপকার হবে তাতে পার্টির কিছু যায় আসেনাআমাদের ওয়াটসন সাহেব বলতেন পার্টিকে সব সময় বোঝাতে হবে যে এটা করলে, তার কি কি লাভ হবে। আর  যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, তার সম্পর্কে আগের থেকে ভাল করে খোঁজ খবর নেবে”ছেলেটি ঘাড় কাত করে তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে মন দিয়ে সব শুনছিল। হরি বাবু থামতে এবার সে বললে-সত্যি আমরা কত কম জানি।আরো আগে এলে অনেক কিছু......”।তাকে শেষ করতে না দিয়েই হরি বাবু আবার শুরু করলেন -“শুধু তাই নয় জানতে হবে কিসে পার্টি কনভিন্সড হয়, কি কি তার পছন্দ অপছন্দ, কোথায় কোথায় তার দুর্বলতা, কি ভাবে তাকে বধ করবে, এই  বধের কথাটা বলার সময় তিনি একটু চোখ টিপে হাসলেন। তারপর বললেন, মনে রাখবে আলাদা আলাদা পারটির জন্যে আলাদা আলদা কায়দা।যে কায়দায় একজন চাকুরী জীবী ঘায়েল হবে,তা দিয়ে কোন ব্যবসায়ীকে পটাতে পারবে না। সুতরাং কার সঙ্গে কিভাবে ডিল করবে সেটা আগের থেকে ঠিক করে নেবে। আর এ গুলো রীতিমতো হোম ওয়ার্ক করে ঘর থেকে বের হবে।এবার দাও দেখি কি এনেছ ব্যাগে করে”। ছেলেটি চুপ চাপ ব্যাগ থেকে একটা বীমার কন্ট্রাক্ট ফর্ম বার করে তার হাতে দিয়ে সবিনয়ে বলল-“ আপনাকে আর নতুন কথা কি বলব জ্যেঠু, সরি স্যার? আপনি তো সবই জানেন। শুধু চেকটা এখনই দিলে ভাল হয়। পরে আর একদিন নাহয়  শুধু আপনার কথা শুনতেই আসব”।–“ সেই ভাল সেই ভাল হাতে একটু সময় নিয়ে আসবে বুঝেছ”  বলে হরি বাবু ঘর থেকে একটা চেক এনে সেটায়, আর কন্ট্রাক্ট ফর্মে সই করে ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন-“তোমার সঙ্গে কথা বলে বড় ভাল  লাগল। আর এর পরে যে দিন আসবে সব কিছু বেশ ভাল ভাবে বুঝিয়ে বলব। তবে ওই কথাটা সব সময় মনে  রাখবে, যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ...............”।
চেক আর ফর্মটা হাতে নিয়ে, ছেলেটি গভীর মনোযোগ সহকারে সে দুটি পরীক্ষা করে ব্যাগে গুছিয়ে রাখল।
হরি বাবু লক্ষ করলেন যে চেকটা হাতে পাওয়া মাত্র ছোকরার মধ্যে থেকে ম্যাদামারা অপ্রতিভ ভাবটা মুহূর্তের মধ্যে উধাউ হয়ে গেল তিনি মনে মনে বললেন-“তার মানে ছোকরা এতক্ষণ অভিনয় করছিল”     
ব্যাগটা হাতে নিয়ে নমস্কার করে উঠে দাঁড়িয়ে সে বিনম্র ভাবে বললে-“আমি আপনার সব বক্তব্যের সঙ্গে একেবারে একমত। এখানেও আমি খোঁজ খবর নিয়েই এসেছিলাম”        
হরি বাবু গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-“ কি রকম খোঁজ খবর”?   
ছেলেটি হেসে বললে-“ ওই যে আগে আপনি সেলসে ছিলেন এবং কথা শুনতে কম বকতে বেশী ভালবাসেন আর আপনার কাছ থেকে কাজ নিতে গেলে কিছু বকুনি   অবশ্যই শুনতে হবে      
এরপর দরজা দিয়ে বেরনর সময় পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা মুচকি হাসি হেসে বললে- “ সেই জন্য পাড়ার ছেলেরা আপনার নাম দিয়েছে বক্তিয়ার খিলজী।  তবে এর পরে যে দিন আসব...” হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ছেলেটি
 অপমানে হরি বাবু  জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ।  
                                               
   
 তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
 পি ১০৬এ সেনহাটি কলোনি
 বেহালা- ৭০০০ ০৩৪।
ফোঃ ৯৮৩৬৭১৩১৮৩                                      


2 comments:

  1. salesman ta bajimat kore dilo :P..maujar golpo :)

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো তরুন দা......অমিয়।

    ReplyDelete