Monday, 17 October 2016

ছিন্ন মূল (৩)

                
                                                      (৩)
এতক্ষণে সে পৌঁছুল দমদমার  মাঠে।মাঠে নেমেই ও বাজাতে শুরু করল রবি ঠাকুরের গান- গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ এই মাঠটা এতই বিশাল যে এপার ওপার দেখা যায়না অথচ মাঠে  গাছপালা বলতে মাঝ মাঠে শুধু  মাত্র একটা প্রাচীন বট গাছ। তবে ঘাস অবস্য হয় খুবইতাই রাজ্যের রাখালেরা আসে এ মাঠে গোরু  চরাতে। গোরু গুলকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে , তারা খেলা করে বটতলায় বসে অতসী এগিয়ে চলল পায়ে চলা  আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে। বটতলার কাছাকাছি আসতেই রাখালের দল ছেঁকে ধরল তাকে। -“ ও অতসী দিদি ক’টা গান শুনিয়ে যানা রে”? কি আর করে সে? বসে পড়তে হ’ল বটতলায়মাথার ঝুড়ি কাঁধের ঝোলা নামিয় রেখে,  তার বেহালা বাজিয়ে গলা ছেড়ে কটা গান গাইল তারপর হাসি মুখে তাদের কাছে বিদয় নিয়ে অতসী চলল মাঠ ভেঙ্গে।মাঠের মাঝে পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথটা দেখে, মনেমনে সে বলল- মানুষের পায়ে চলা পথ মাত্রই এরকম আঁকা বাঁকা  হয় কেন ? সোজা সোজা হয় না কেন? হয়তো মানুষ সোজা পথে  চলতে জানে না। নাকি  পারে  না ? বটতলা থেকে অনেক গুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে এদিক  সেদিক।কোনটা গেছে পূব পাড়ায়, কোনটা ক্ষিরীষ তলা আবার কোনটা হাট তলার দিকে মাঠের বুকে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু শুকিয়ে যায়নি এখনও।শিশিরে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে, ভেসে বেড়াচ্ছে নাম না জানা কোন বনফুলের গন্ধ। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে চরে বেড়াচ্ছে গোরুর পালসাদা সাদা গো বক গুলো গরুদের পিঠে চড়ে ঘুরছে,আর তাদের গা থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে  খাচ্ছে।কচি বাছুর গুলো ল্যাজ তুলে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে
কাক শালিক শ্যামা ফিঙের মতো পাখী গুলো মাঠের বুক থেকে পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। শীতের ভোরের নরম আলোয় সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে কুয়াশার পর্দা কাক ডাকছে, ডাকছে আরও কতো রকম পাখী। শুন্য গগনে পাক খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চিল শকুনের দল। ডাইনে বাঁয়ে  যেদিকে তাকাও মাঠের সীমানার বাইরে বহু দূরে পটে আঁকা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছের সারি।আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হাটের পানে এগিয়ে চলেছে অতসীভুবন  পুরের গঞ্জে হাট  বসে সপ্তাহে দুদিন,সোম আর শুক্কুর বার। অন্যান্য দিনে  অতসী আর যা করে করুক না কেন, হাট বারে  ওর কিন্তু হাটে আসা চাই ই চাই। প্রথমত এখান থেকেই ও ওর ফেরির মাল প্ত্র গুল কেনে। দ্বিতীয়ত হাটে এ দোকান সে দোকানের ফাই ফরমাজ খেটেও দু চার পয়সা জোটে তারহাটে পৌঁছে প্রথমে সে ডাক বাক্সে চিঠিটা ফেললে, তারপর গেল বিশু জ্যাঠার  দোকানে। তার মা  ও  এখান থেকেই মালপত্র নিত। বিশুজ্যাঠা অতসীকে দেখে বললে – এতক্ষণে এলি রে  মা ?  এদিকে দেখ  না বলাইটা আজ কাজেই আসেনি। একা আমি আর কত দিক সামলাই বল ? ওদিকে নতুন মাল গুলো সহর  থেকে নৌকোয় এসে গুদমে পড়ে  রয়েছে  গুছিয়ে রাখার লোক ও নেইঅতসী হাসি মুখে বললে- আচ্ছা আমি দোকানে বসছি, তুমি গুদম থেকে ঘুরে এসখানিকক্ষন পরে বিশুজ্যাঠা ফিরে আসতে তার সঙ্গে কাজের কথা সেরে, অতসী গেল পরাণ হাজরার দোকানে।  হাজরা মোশাই ও এটা সেটা বলে তাকে দিয়ে দোকানের কিছু কাজ করিয়ে নিলেন। আসলে ওর মতো একজন সহায় সম্বল হীনা অনাথা  নারীকে হাতের কাছে পেয়ে যে যার মতো খাটিয়ে নেয়। কেউ কিছু দেয়, কেউবা কিছুই দেয় না।ও যেহেতু গরীব  আর এইসব দোকানদারদের কাছ থেকে ধারে মাল নিইয়েই ওর চলে,তাই বলার কিছু নেই, করার ও কিছু নেই।এখনও অন্যায় আব্দার কেউ করেনি, তবে করলেই হল। এ ভাবেই চলবে ওর জীবন।এরপর ননী পালের দোকান থেকে যেই না ও বেরিয়েছে সামনে পড়ল বিপিন ঘটক। ঘটক মশাই এর কাজ ঘটকালি করে বেড়ান। অতসীকে সামনে পেয়ে সে বললে-“এই যে মেয়ে, তোরেই খুঁজতে ছিলাম। তা বলি বে থা কিছু করবি, না সারা জীয়নটা  ওমনি গাঁয়ে গাঁয়ে নেচে বেড়াবি? এদিকে পাঁচ জনে  তো পাঁচ কথা বলে বেড়াচ্ছে ? অতসী হেসে বললে- খেয়েদেয়ে যাদের কাজ কম্ম নেই তারাই অমন এর তার নামে বলে বেড়ায়। এই আমি বেশ আছি। নিজে কামাচ্ছি নিজে খাচ্ছি। কোন ঝুট ঝামেলা নেই। আর আমি আমার নিজের গতরে খেটে খাই, কে কি বলল তাতে  কিছু যায় আসে না আমার– আহা সে তোর কিছু না এলে গেলেও, আমাদের সমাজ বলে তো একটা  কিছু আছে?না কি  নেই? তাই বলি কি ভাল একটা পাত্তর আছে।  বে করবি তো বল? অতসী অবাক হ’ল। এর আগে কেউ কোনদিন ওকে এমনি গায়ে পড়ে  বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। লজ্যায় মাটিতে মিশে গিয়ে, ও মাথা নীচু করে  কোনক্রমে বললে – না না ওসবের মধ্যে আমি নেই ।ঘটক বললে- আরে শোন শোন পাত্তর যে সে লোক লয়, আমাদের ক্ষিরীষ তলা গাঁয়ের সতীশ মোড়ল। গেল বছর ওর পরিবারটি  মরে যেতে বড্ড কষ্টে আছে বেচারা অনেক গুলো ছেলে মেয়ে তো?  তাদের মুখচেয়েই আবার বে করতে চাইছে। তাই আমায় বলছিল......। তাকে শেষ করতে না দিয়ে অতসী  মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল - উনারে আমি চিনি।উনার বয়স তো তিন কুড়ি হলআর  আমার থেকে ও  বড় বড় ছেলে মেয়ে আছে ওনারঘটক বললে -না না তিন কুড়ি  হবে কেন? হ’লে বড়জোর কুড়ি দুই  আড়াই  হোতি পারে। আর ছেলে মেয়েরা বড় তো কি? যাকে বলে একেবারে জমজমাট সংসার, তোকে তারা খুব যত্ন আত্তি তে রাখবে অমন  সরেস মালদার পাত্তর তোর  জুটবে কী ? থাকিস তো জঙ্গলে  কুঁজি  ঘর বেঁধে।এদিকে তোর বাপের......। অতসী জানে এরপর ঘটক আর কি বলবে। সে তাই হনহন করে  সেখান থেকে হাঁটা দিলে।শুনতে পেল ঘটক মশাই  পিছন থেকে তখনও বলে চলেছে- এই শোন তাড়াহুড় নেই ভাল করে ভেবে দেখিসবিপিন ঘটক লোক ভাল নয়সে পিছন থেকে চেঁচিয়ে অতসীকে ওকথা বললেও,মনে মনে বললে- দাঁড়া  মাগী থাকিস ত জঙ্গলে,আর গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াস একা একা।জালে যখন ফাঁসাব তখন বুঝবি।

অতসী গিয়ে  বসল কেষ্ট ময়রার  দোকানের  বেঞ্চির এক কোনে। আজ ঘুরে ফিরে  খালি মায়ের কথা  মনে পড়ছে ওর, আর মনটা খারাপ  হয়ে যাচ্ছে। আজ মা থাকলে ওই ছোটলোক ঘটকটা ওর  সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলার সাহস পেত না।  উদাস হয়ে ও যখন তার মায়ের কথা ভাবছে, সেই সময় ভাল শাড়ি কাপড় পরা, সাজগোজ করা, প্রায় ওর সমবয়সী একটা মেয়ে,ওর গা ঘেঁষে  পাশে এসে বসল।  অতসী অন্যমনস্ক ছিল বলে প্রথমটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করল, যখন সে  কথা  কইল।–হ্যাঁরে  তুই অতসী না ?  অতসী চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে যাকে দেখল, চিনতে পারল না।  কোনদিন  কোথাও  তাকে দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না। অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।  -চিনতে পারলি না ?আরে আমি রমা ?  পূব গাঁয়ের রমা, অনেক বছর আগে তুই তোর মায়ের সঙ্গে আসতি না আমাদের গাঁয়ে ? তোর মা জিনিষ ফেরি করত, আর তুই তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতি ? মনে পড়ে ?  এবার অতসী বললে – তা মনে পড়বে না কেন ? তবে তোমায় কিন্তু ঠিক......? তাকে শেষ করতে না দিয়ে  রমা হেসে বললে– আমায় ঠিক চিনতে পারছিস না তো? তা তো হবেই, সে তোর আর দোষ কি বল ? বিয়ে হয়ে থেকে বছরে শুধু একবার এই মাঘ মাসটাতেই যা বাপের বাড়ি আসতে পারি। বাকি  সারাটা বছর বোম্বাই য়েই কাটাতে হয়। বোম্বাই এর নাম অতসী শুনেছে বটে, তবে সে দেশটা যে কোথায় কতদূরে তা সে জানে না। জিজ্ঞাসা না করে পারল না  যে সে দেশ এখান থেকে কত দূরে, এবং কিভাবে যেতে হয়?  রমা হেসে বললে –সে অনেক দূর, রেলে চেপে যেতে হয়। যাবি তুই আমার সঙ্গে?  ওখানে আমার খাওয়াদাওয়া পয়সাকড়ি অঢেল, কিন্তু কথা বলার একটা লোক পাইনা। তুই গেলে বেশ হবেঅতসী বললে- না বাবা, এখানেই আমি বেশ আছি। আসে পাশের পাঁচটা গাঁয়ের মানষে   আমায় চেনে। বিপদে আপদে সাহায্যও পাব।মায়ের হাতে গড়া ঘর আর জঙ্গল ছেড়ে আমি কথাউ যাব না রমা গম্ভীর গলায় বললে – সে তোর ইচ্ছা। যাবি তো যাবি, না যাবি তো না যাবি।কিন্তু তুই যে ভাবছিস এখানে সবাই তোকে ভালবাসে? আর আপদে বিপদে দেখবে? সেটা বোধহয় ঠিক নয়।সত্যি বিপদে কখনো পড়লে তা বুঝবি। আসি রে, সামনের সোমবার পর্যন্ত আছি। ভেবে দেখিস। হাওয়ায় উগ্র সহুরে গন্ধ  ছড়িয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গেল রমাযাবার সময় মনে মনে বললে- সোজা আঙুলে  ঘী উঠবে না মনে হচ্ছে।আমাকে ত তুমি চেন না?পিছনে এমন লোক ফিট  করে দেব, যে টোপ তোমায়  গিলতেই হবে।রমা উঠে যেতে তার জায়গায়  আধ ময়লা মোটা ধুতি পরে যে লোকটা এসে বসল, অতসী তাকে  রঘু কাকা  বলে ডাকে। রঘুও অতসীর মতোই ফেরি ওয়ালা। হাটে সে কড়াই মুড়ি ফেরি করে অতসীর মা তাকে দাদা বলে ডাকত।অতসী ডাকে রঘুকাকা বলে। অতসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে, চাপা স্বরে ফিসফিস করে রঘু জিজ্ঞাসা করল – তোকে কি বলছিল রে ওই পূব গাঁয়ের মেয়েটা ? রঘুকাকার কথা বলার ধরন দেখে একটু অবাক হল ও। তবু গলা নামিয়ে সেও ফিসফিস করে বললে –আমায় বলেছে ওর সঙ্গে বোম্বাই এ যেতে গলার স্বরটা আরও খাদে নামিয়ে রঘু বললে – খবরদার ওর সঙ্গে কোথাও যাবি না। ও হ’ল কুনকি   হাতি।ফিসফিস করে জানতে চাইল অতসী -কুনকি হাতি আবার কি ? – জানিস না ?  কুনকি হাতিরা  অন্য হাতিদের ভুলিয়ে ভালিয়ে খাদে এনে ফেলে এও তেমনি গ্রামের মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে সহরে নিয়ে গিয়ে গাড্ডায় ফেলে,তারপর তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করায় আর একবার ওর পাল্লায় পড়লে পর, ফেরার আর কোন রাস্তা থাকে না। এর আগে যারা যারা ওর সঙ্গে সহরে গেছে তারা কেউ আর ফেরে নি  

ছিন্ন মূল (৫)


                               ছিন্ন মুল(৫)

প্রতি হাটবারে সন্ধ্যার মুখে পড়ন্ত বেলায় অতসী মাঠ পার হয়ে এমনি করে ঘরে ফেরে। বেলা পড়ে  এলে রাখালেরা হৈ হৈ হ্যাট হ্যাট করে কঞ্চির ছপটি আর পাঁচনবাড়ি মেরে গোরু গুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গোয়ালে ফে্রে।  এক দেড়শ গোরুর ক্ষুরে মেঠো পথের ধুলো রেনু রেনু হয়ে বাতাসে উড়ে  বেড়ায়তার  উপর পড়ন্ত বেলার হলুদ রোদ্ পড়ে মনে হয় যেন আকাশ থেকে  সোনালী রঙের  মেঘরাশি  মাটিতে নেমে এসেছেএকেই বোধহয় গোধূলি বেলা বলে। অতসীর মাথার উপর দিয়ে চারি  দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা সব বাসায় ফিরছেসন্ধ্যা নামলে সকলেরই বাসায় ফেরার  তাড়া থাকে কিন্তু  নদীর পাড়ে খেয়া ঘাটের ওই লোকটা,  বলে কিনা তার কোন বাসা নেই। এমন অদ্ভুত কথা  জীবনে কখনও শোনেনি অতসীসে আবার বলে কিনা, লৌকোয় চড়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়।  লোকটাকে দেখতে ঠিক যেন বাঁশী হাতে কেষ্ট ঠাকুরটি ক্যালেন্ডার থেকে বেরিয়ে এসেছে গায়ের  রঙটি মাগুরে শ্যামলা হলেও নাক চোখ মুখ ভালোইতা সে নিজেই বা কি এমন ফর্সা? আপন মনে  বক্ বক্ করতে করতে মাঠ ভেঙ্গে ঘরে ফিরছিল অতসী। এই শেষের কথাটায়  এসে ওর চমক  ভাঙ্গল এটা কিরকম হলো? হঠাৎ  ও তার সঙ্গে নিজের তুলনা করে বসল কেন? তাহলে কি তাকে ও তাকে.....? আর ভাবতে   পারলনা সে।শরীরে মনে তার অনির্বচনীয় এক পুলক ছুঁয়ে গেলখিল খিল করে  কিশোরীর  মতো হেসে উঠে সে একা একা মাঝ মাঠে অন্ধকারে  একটু নেচে নিলে হাট থেকে অন্ধকারে একটি লোক ওকে পিছন থেকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে আসছিল, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে  ওর নাচ দেখল।গাঁয়ে ঢুকে প্রথমে বিশ্বেস মাসিমার হাতে পানের গোছাটা ধরিয়ে দিয়ে অতসী বনে ঢুকল একটু দুরত্ত রেখে তার পিছন পিছন যে আসছিল, সেও বনে ঢুকে, একটা গাছের  আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। বনে ভোর হতে না হতেই  যেমন পাখ  পাখালি  কিচিরমিচির শুরু করে দেয়, তেমনি একটু অন্ধকার হলেই পাখিরা সব চুপ মেরে যায়। তখন শোনা যায় শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার  একটানা ঐকতান, আর থেকে থেকে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক।  আজ আবার এটাসেটা করতে গিয়ে অতসী  ঘরে ফিরতে খানিকটা দেরি করে ফেলেছে। যাইহোক  ঘরে ঢুকে প্রথমে সে তার কেরোসিনের কুপি বাতিটা জ্বালল তারপর হাত পা ধুয়ে, রোজকার মতো ইট সাজিয়ে উনুন বানিয়ে তাতে শুখন ডালপালা গুঁজে  আগুন দিয়ে ভাত চড়াল।খাদ্য তার সামান্যই ভাতেভাত, তাই খেয়ে নিয়ে সে বসল এক গাছ তলায় পা ছড়িয়ে।যদিও মা ওকে পই পই করে বলত- দেখ অতসী দিনমানে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তুই যা করিস তা করিস,সূর্য ডোবার পর কিন্তু জঙ্গলে আর ঘুরবি না।অতসী কিন্তু মোটেই ঘরে থাকতে পারে না।তার দম বন্ধ হয়ে আসে।  তাই সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর খানিকক্ষন সে খোলা আকাশের নিচে,গাছ তলায় বসে।আজও বসে বসে সে  ভাবতে লাগল সারা দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা  গুলো। কিন্তু সবকিছু ফেলে বারবার ওর সেই খেয়া ঘাটের ঘটনাটা, আর সেই কানাই না নিতাই কি যেন নাম ছেলেটার? তার কথাই ঘুরে ফিরে মনে পড়তে লাগল ক্ষণে ক্ষণে তার মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আর তার কথা ভেবে শরীরে মনে পুলক জাগছে, আবার অন্ধকারে একা গাছ তলায় বসে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে তার মুখ খানি কখনও বা পাপ বোধের সঙ্গে একটু ভয় ভয় ও করছে ওরযাবে নাকি খেয়া ঘাটে গল্প শুনতে? খেলনা ব্যায়লাটা ত সে অনেক দিনই বাজাচ্ছে, রোজ কত লোকে শুনছেও, কিন্তু কৈ কেউ ত কোনদিন এভাবে ওর প্রশংসা করেনি? অতসী এবার  নিজেকে নিজে ধমকে উঠল।

- আঃ কি যাতা ভাবছিস লো পোড়ারমুখী?কোথাকার কে একটা ছোঁড়া?হেসে একটু মিষ্টি করে কথা  বললে আর অমনি তুই  গলে গেলি?কে জানে কি আছে তার মনে?খবরদার বলছি যাবি না তুই খেয়া ঘাটে।–আহা কি হবে গেলে?খেয়ে ফেলবে নাকি? এইভাবে কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজে ঝগড়া  করতে করতে, হঠাৎ তার খুব হাসি পেল, জোরে খিল খিল করে হেসে উঠল ওআর সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকে কে একজন ধুপ ধাপ শব্দ করে ছুটে পালাল।অতসীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।কে লুকিয়ে ছিল ওখানে? আর হঠা ছুটে পালালই বা কেন? জীবনে এত ভয় কোনদিন পায়নি ও। উঠে দাঁড়িয়ে  পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল।তবু ভয়টা কিন্তু যাচ্ছেনা।শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর ভাবছে যে কি মতলবে লোকটা বনে ঢুকেছিল কে জানে? তবে যদি কোন বদ মতলব তার থেকেই  থাকে, তবে একা মেয়েমানুষ তার হাত থেকে সে বাঁচবে কিভাবে?এই ত তার দরমার ঝুপড়ি?এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।কিন্তু ভোর রাত্রে মাকে স্বপ্নে দেখে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর কি যেন বলার চেষ্টা করছিল মা?ও বুঝে উঠতে পারেনি                          

Monday, 3 October 2016

লুচি


                              লুচি

ভোলা কোন দিন লুচি খায়নি।চেখে দেখা তো দূরের কথা সে জিনিষ সে চোখেই কোনদিন দেখেনিশুধু মায়ের মুখে   শুনেছে যে ওর বাবা কলকাতা শহরে যে বাড়িতে রান্না করতেন তারা খুব লুচি খেত।শুধু ভোলাই নয়, ওদের গাঁয়ের কোন বাচ্ছাই কোন দিন লুচি খায় নি।তার উপর ভোলা যখন খুব ছোট তখন ওর বাবা ওকে রেখে মারা যান। তারপর থেকে তার মা একাই খেটে খুটে কোন রকমে সংসার চালান এদিকে ভোলা যখন তখন লুচি খাবার বায়না ধরে। আর পা ছড়িয়ে বসে হাপুস নয়নে কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে  – “আ...মি লু ......চি ...খা ...ব।তখন ওর মা ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন –“বেশ তো বাবা খাবি।তুই অনেক অনেক লেখাপড়া করে বড় হ, তারপর বড় হয়ে বড় চাকরী করে অনেক টাকা রোজগার করে যখন বড় মানুষ হবি, তখন লুচি  খাবি।ভোলা কান্না থামিয়ে গোল গোল চোখ করে মায়ের কাছে জানতে চাইত- লুচি খেতে গেলেও পড়াশুনো করতে হবে?
-হ্যাঁ বাবা পড়াশুনো ছাড়া কোন গতি নেই।
-বাবা বুঝি অনেক পড়াশুনো জানত?
-জানতই ত? না হলে কি আর জমিদার বাড়ি কাজ পায়?
সাধারণত নিচু ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কোন Ambition থাকে না, তারা পড়তে হয় তাই পড়ে।কেন যে পড়ছে তাও বোঝে না।কিন্তু ভোলার মা নিজে লেখাপড়া না জানলে কি হয়? নিচু ক্লাসেই ভোলার মধ্যে একটা Ambition  তৈরী করে দিলেন।লুচি যদি খেতে হয় তো পড়াশুনো করতে হবে।আর ভোলাও রোদ্দুর জল ঝড় উপেক্ষা করে, মাইল তিনেক হেঁটে বই বগলে পাশের গাঁয়ের ইস্কুলে যেতে লাগল  বড় হয়ে চাকরি করে লুচি খাবার জন্যে।ছোট বেলা থেকেই সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ কবিতাটা তার  প্রিয়।এবং একেবারে কণ্ঠস্থ।আবৃত্তি করতে বললেই সে ঐ কবিতাটা হড় হড় করে আওড়ে দেয়।সে দৃঢ়  প্রতিজ্ঞা নিয়ে মন দিয়ে পড়াশুনো করে যথা সময়ে, সম্মানে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল।এবার সে  কলকাতায় যাবে চাকুরী খুঁজতে আর লুচি খেতে।ইস্কুলের মাস্টার মশাইরা কিন্তু তাকে আর তার মাকেও অনেক করে বুঝিয়ে বলে ছিলেন, যে উচ্চমাধ্যমিকটা অন্তত পাশ করুক, তারপর চাকরীর চেষ্টা করুক।কিন্তু ভোলাকে ভোলান গেল না।তার আর তর সইছে না।সে অনেক বছর অপেক্ষা করেছে, আর নয়। তাকে এক্ষুনি কলকাতায় যেতে হবে চাকরী খুঁজতে আর সেই সঙ্গে......।
ভোলা আজ কলকাতায় যাবে।তাই গাঁ জুড়ে সাজ সাজ রব।কারন ভোলার মতো মাধ্যমিকে অনেকে পাশ করলেও সে একাই কলকাতায় যাচ্ছে চাকরী খুঁজতেভোলার মা, ঠাকুরের থানে মানত করলেন, ভোলা যেন জমিদার বাড়িতে গিয়ে তার বাবার কাজটা পেয়ে যায়।ওদের গাঁয়ের এক দাদু ভোলাকে জিজ্ঞাসা  করলেন- তা বাবা ভোলা কলকাতায় গিয়ে তুমি উঠবে কোথায়?
ভোলা বুক চিতিয়ে গর্বের সঙ্গে উত্তর দিয়ে ছিল – কেন?জমিদার বাড়িতে? বাবা যেখানে কাজ করত, সেই মস্ত  বড় লাল দুতলা বাড়িতে?   
-    সে বাড়ি তুমি চেন?
-    চেনা চিনির কি আছে? তারা খুব বড় লোক, রোজ দু বেলা লুচি খায়।সবাই তাদের চেনে।শ্যালদা ইষ্টিশনে জিজ্ঞাসা করলেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
যথা সময়ে দুগগা দুগগা বলে ভোলার মা, তার হাতে ফুল কাটা টিনের পেঁটরা আর বগলে বিছানা মাদুর দিয়ে, ইষ্টিশন থেকে রেলে চাপিয়ে রওনা করিয়ে দিলেন।আর পোই পোই করে মনে করিয়ে দিলেন যে কেউ যদি জানতে চায় যে ও কলকাতায় কেন যাচ্ছে?ও যেন চাকরীর কথা বলে। ভুলেও লুচির নাম যেন উচ্চারণ না করে।আর কলকাতায় পৌঁছে সবার আগে সে যেন একটা পোস্টো কার্ড ফেলে,তার পৌঁছনর খবর দেয়। জীবনে এই প্রথম ভোলা একা একা রেলে চেপে দূর দেশে পাড়ি দিচ্ছে, ফলে সে একটু দুরু দুরু বক্ষে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল এক দাদু ওকে জিজ্ঞাসা করলেন–কত দূর যাবে খোকা? খোকা ডাকটা ভোলার মোটেই ভালো লাগলো নাহতে পারে ও বয়সের তুলনায় ও একটু বেঁটেই, তা  বলে ওর মতো  দস্তুর মতো একজন মাধ্যমিক পাশকে খোকা বলবে?মুখ গোঁজ করে সে উত্তর দিল- কলকাতায়।
- বেড়াতে যাচ্ছ বুঝি?
-না, চাকরী খুঁজতে আর লুচি...।
-চাকরীটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু লুচিটা কি?
-না।লুচি কিছু নয়।
দাদু হাসতে হাসতে বললেন –কিছু নয় বললে হবে?আমাদের সময়ে লুচিই ছিল আসল খাবার।বিয়ে বাড়ি বল?অন্নপ্রাশন পৈতে বল?জামাইষষ্ঠী ভাই ফোঁটা বল?লুচি ছিল একেবারে যাকে বলে মাস্ট। কুমড়োর ছক্কার সঙ্গে লুচি।ছোলার ডালের সঙ্গে লুচি।বোঁদে পায়েসের সঙ্গে লুচি।লুচি ছাড়া কিছু ভাবাই যেত নাএকজন সহযাত্রী বললেন সে কথা আর বলতে?তবে সে সব দিন কি আর আছে?সে রামও নেই, সে অয্যোধ্যাও নেই।ভালো ঘীইও নেই আর লুচিও নেই।  ডালডায় কি আর লুচি হয়? খেলেই অম্বল তাই আজকাল লুচির আকাল পড়েছে আগের মতো আর লুচির দেখাই পাওয়া যায় না।ভোলা কান খাড়া করে সবার কথা শুনছিল।সে ভীষণ রকম দমে গেল। তাহলে কি দেশ থেকে লুচি একেবারে ভ্যানিস হয়ে গেল?এখন কি হবে?তাহলে জমিদার বাড়ি গিয়েই বা কি হবে?মা বলেছিল লুচি খেতে হলে পড়াশুনো করতে হবে।মায়ের কথা শুনে সে পড়াশুনো করেছে,মাধ্যমিক পাশও দিয়েছে, আর এখন শুনছে যে দেশ  থেকে নাকি লুচি খাওয়াটাই উঠে গেছে।কান্না পেতে লাগল তার সেই সময় হঠাৎ তার মনে হল যে কামরার এই লোক গুলো তো তাদের গাঁয়ের লোকেদের  মতোই গরীব, তাই বলছে  লুচি পাওয়া যায় না। তাই  বলে কি জমিদাররা,  যারা আগে দুবেলা লুচি খেত তারাও খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে? নিশ্চই না। সুতরাং এদের কথা শুনে হাল ছাড়লে চলবে না।একবার বাড়ি ছেড়ে যখন বেরিয়েছে, তখন শেষ দেখে তবে ছাড়বে।কিন্তু শ্যালদা ইষ্টিশনে নেমে সে থমকে একেবারে থ মেরে গেল। শয়ে শয়ে লোক পিঁপড়ের মতো লাইন দিয়ে, এ গেট সে গেট দিয়ে পিল পিল করে দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।পৃথিবীতে এতো যে লোক আছে তা জানত না ও। এতো লোক একসঙ্গে দেখেওনি সে কোন দিন ।আর তারা সব দল বেঁধে এক এক দিকে  ছুটে চলেছে কেউ ছুটছে ডান দিকে, তো কেউ  বাঁদিকে। কেউবা ছুটছে সোজা নাক বরাবর।দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কাউকে যে সে কিছু জিজ্ঞাসা করবে? তা লোকের গুঁতোয় গুঁতোয় সে একেবারে জেরবার। আবার বগলের মাদুর জড়ান বিছানাটা নিয়েও হয়েছে আর এক জ্বালা।লোকের ধাক্কায় ধাক্কায় মাঝে মাঝেই সে বোঁ করে চরকি ঘোরান ঘুরে যাচ্ছে।এর সঙ্গে জুটছে ফ্রি স্যামপেলের কুবাক্য- কোথাকার উজবুক রে, আর সময় পেল না, আপিস টাইমে  লাট খাচ্ছে। কিন্তু ভোলার সমস্যা হল যে ও বুঝেই উঠতে পারছে না যে কোন দিকে যাবে? শেষে ভাবলে যে, যা থাকে কপালে গড্ডালিকা প্রবাহে  ভেসে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যাক। তারপর জমিদার বাড়ি খুঁজে নেয়া যাবে।স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে সে আরো অবাক হল মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ির ভিড় দেখে।কিন্তু এখানেও সেই একই অবস্থা,কেউ কোথাও দুদণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে নাকেউ ওর দিকে তাকাচ্ছেও না।দিকে দিকে বন্যার জলের মতো বয়ে চলেছে লোকজন।ভোলা কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ,জমিদার বাড়ি তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।এদের মধ্যে কেউ না কেউ ওর কথা শুনবে।ও লোকেদের পিছনে, ঠেলার পিছনে,সাইকেলের পিছনে,রিকশার পিছনে,ছুটে ছুটে জনে জনে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো – হ্যাঁ ভাই বলতে পার জমিদার বাড়িটা কোন দিকে?একটা লোক বগলে একটা ছাতা নিয়ে হন হন করে হেঁটে যাচ্ছিল, ভোলা তাকে তাড়া করল- এই যে ও ভাই, ও দাদা, ও ছাতা বগুলে দাদা, বলি জমিদার বাড়িটা কোন দিকে......।এ লোকটিও কোন উত্তর না দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে বেরিয়ে চলে গেল।ভোলা পরিশ্রান্ত হয়ে  আবার স্টেশনে ফিরে এসে এক যায়গায় বসে পড়ল।নাঃ কেউ ওর কথা শুনছে না।তাহলে কি করবে এবার?আবার গাঁয়ে ফিরে যাবে? হঠা ওর নজরে পড়ল লাল জামা পরা একজন লোক, একটা বড় ঝুড়ির উপর বসে আপন মনে খৈনী ডলছে। লোকটিকে ওর বেশ পছন্দ হল।হ্যাঁ, একেই জিজ্ঞাসা  করা যেতে পারে জমিদার বাড়িটা কোথায়? পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে বিনয়ে বিগলিত হয়ে হসি হাসি মুখে বলল- ভাই মুটিয়া, জমিদার বাড়িটা কোন দিকে বলতে পার? লোকটি  খৈনীতে তালি মারতে মারতে বলল – কৌন সা জমাদার?
-     আরে জমাদার নয়, জমিদার, জমিদার কা বাড়ি খুঁজতা হ্যায়। (আজকাল হিন্দিগান আর সিনেমার কল্যাণে গাঁয়ের মানুষেরাও একটু আধটু হিন্দি বলতে পারে )
-     জমিনদার? জমিন্দার লোগ তো গাঁও মেঁ র‍্যাতা হ্যায়। ইখানে কুথায় মিলবে?
-     আরে গেরামের নয়, খোদ শ্যালদা কা জমিদার হ্যায়।মস্ত বড় লাল দোতলা বাড়ি হ্যায়।আর তারা রোজ দুবেলা লুচি খাতা হ্যায়।তুমি তাকে চিন্তা হ্যায়?
লোকটি নিজের মনে বিড় বিড় ক’রে আওড়াল – দুবলা জমিন্দার রোজ  লুচি খাতা হ্যায়? তারপর ভোলা কে বললে – ঠিক হ্যায় তুম হিঁয়া পর ব্যায়ঠো,  হাম  আভি পাতা লাগাকে আতা ভোলাকে বসিয়ে সে হাওয়া হয়ে গেল।  আর ভোলা সেখানে বসে বসে কলকাতার চলমান দৃশ্য দেখতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে লাল জামা ফিরে এসে বললে –মিল গিয়া। চল তুম হামারা সাথ। ভোলা লাল জামার পিছন পিছন চলল। কিছু দূর হেঁটে, কয়েকটা রাস্তা পার হয়ে এক জায়গায় এসে, দূর থেকে লাল জামা তাকে একটা লাল  রং এর বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। ভোলা গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়াল সেই  বড় বাড়ির বড় গেটের সামনে। সেখানে তখন পাহারা দিচ্ছিল বিশাল  চেহারার এক দারোয়ান। সে হেঁকে বললে- ইয়ে লেড়কা কিস কো মাংতা। ভোলাও সমান তেজের সঙ্গে জবাব দিলে – জমিদার বাবু কো মাংতা
-কিঁউ মাংতা?
- আরে হামারা বাবা যে এখানে লুচি ভাজতা......।
-হাঁ হাঁ সামঝা, ভিতর মে চলিয়ে যাও সামনে বাবা বৈঠা হ্যাঁয়।
-দূর মুখ পোড়া, সেই কবে হামারা বাবা মর গিয়া ?
গেট খুলে  দারোয়ান তাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।
দুপাশে ছোট বাগান,মাঝখানে মোরাম ঢালা চওড়া রাস্তা।রাস্তা ধরে একটু এগুতেই সামনে পড়ল বাড়িটাবাড়ির একতলায় একজন ভীষণ মোটা  লোক, কোলা ব্যাঙ এর মতো হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে  শুয়ে ঘামছে আর মার খাচ্ছে। তাকে দমাদ্দাম কিল চড় ঘুসি মেরে যাচ্ছে একটা সাঙ্ঘাতিক জোয়ান লোক। ভোলা বুঝতে  পারল না ফর্সা মোটা লোকটা বিনা প্রতিবাদে খামাকা কেন এরকম মার খাচ্ছে ? ।তবে তাদের রকম  সকম দেখে ওর খুব হাসি পেয়ে গেল। সে  নিজেকে সামলাতে না পেরে হো  হো করে হেসে উঠল।তার হাসির শব্দে বারাণ্ডার দুজনে বোঁ করে ঘুরে তার দিকে তাকাল। ফর্সা মোটা লোকটি জমিদার বাবু।সকালে তিনি স্নানের আগে তেল মালিশ করাচ্ছিলেন। ভোলাকে দেখে জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন- কে তুমি? কোত্থেকে আসছ? আর কি চাও? এক সঙ্গে তিন তিনটে প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেল ভোলা। সে ঘাড় মাথা চুলকে, আমতা আমতা করে বললে –  আঁজ্ঞে  আমি ভোলা, বাড়ি থেকে আসছি। একটা লুচি? না লুচি নয়। চাকরী চাই।
-     বাড়ি কোথায়?
-     আঁজ্ঞে ভাটিপোঁতা।
-      ভাটিপোঁতাটা কোথায়?
-     আঁজ্ঞে ওই ঝিকরিপোঁতার পাশে।  
- আর ঝিকরিপোঁতাটা ওই ভাটিপোঁতারই পাশে। তাই তো?
-      একদম কারেক্ট।
-     তা চাকরিটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু লুচিটা কি?
-     আঁজ্ঞে আমার বাবা এখানে লুচি ভাজতেন। সেটাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে।
-     তোমার বাবা আমার বাড়িতে লুচি ভাজতেন ? কবে ভাজতেন ? কি নাম তার ?
-     আঁজ্ঞে মহাদেব পাল।
-     ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, তা সেতো অনেক কাল আগে মারা গিয়েছে ? তুমি কি তার ছেলে ? তা বেশ বেশ  তোমাকে  তো তবে রাখতেই হয়।    
জমিদার বাবুর বাড়িতে ভোলার চাকরী হল বটে, তবে  তার আশা অপূর্ণ রয়ে গেল। সেই রাত্রে সে মাকে চিঠি লিখল–পূজানিয়া মা, জমিদার বাড়িতে আমার চাকুরী হইয়াছে কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শে তাঁদের লুচি খাওয়া চিরতরে বন্ধ হইয়া গিয়াছে।এ বাড়ীতে আর লুচি ভাজা হয় না। পৃথিবীতে এতো ভালমন্দ বস্তু থাকিতে মুখপোড়া  ডাক্তারেরা লুচিটাই যে  কেন বন্ধ  করিল জানি না। তুমি আমার প্রনাম নিও। ইতি ভোলা ।                                             
    
 তরুণ কুমার বন্ধোপাধ্যায়  
০২/১০/২০১৬