Monday, 17 October 2016

ছিন্ন মূল (৩)

                
                                                      (৩)
এতক্ষণে সে পৌঁছুল দমদমার  মাঠে।মাঠে নেমেই ও বাজাতে শুরু করল রবি ঠাকুরের গান- গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ এই মাঠটা এতই বিশাল যে এপার ওপার দেখা যায়না অথচ মাঠে  গাছপালা বলতে মাঝ মাঠে শুধু  মাত্র একটা প্রাচীন বট গাছ। তবে ঘাস অবস্য হয় খুবইতাই রাজ্যের রাখালেরা আসে এ মাঠে গোরু  চরাতে। গোরু গুলকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে , তারা খেলা করে বটতলায় বসে অতসী এগিয়ে চলল পায়ে চলা  আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে। বটতলার কাছাকাছি আসতেই রাখালের দল ছেঁকে ধরল তাকে। -“ ও অতসী দিদি ক’টা গান শুনিয়ে যানা রে”? কি আর করে সে? বসে পড়তে হ’ল বটতলায়মাথার ঝুড়ি কাঁধের ঝোলা নামিয় রেখে,  তার বেহালা বাজিয়ে গলা ছেড়ে কটা গান গাইল তারপর হাসি মুখে তাদের কাছে বিদয় নিয়ে অতসী চলল মাঠ ভেঙ্গে।মাঠের মাঝে পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পথটা দেখে, মনেমনে সে বলল- মানুষের পায়ে চলা পথ মাত্রই এরকম আঁকা বাঁকা  হয় কেন ? সোজা সোজা হয় না কেন? হয়তো মানুষ সোজা পথে  চলতে জানে না। নাকি  পারে  না ? বটতলা থেকে অনেক গুলো পায়ে চলা পথ চলে গেছে এদিক  সেদিক।কোনটা গেছে পূব পাড়ায়, কোনটা ক্ষিরীষ তলা আবার কোনটা হাট তলার দিকে মাঠের বুকে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু শুকিয়ে যায়নি এখনও।শিশিরে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে মিশে, ভেসে বেড়াচ্ছে নাম না জানা কোন বনফুলের গন্ধ। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে চরে বেড়াচ্ছে গোরুর পালসাদা সাদা গো বক গুলো গরুদের পিঠে চড়ে ঘুরছে,আর তাদের গা থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে  খাচ্ছে।কচি বাছুর গুলো ল্যাজ তুলে ঘোড়ার মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে
কাক শালিক শ্যামা ফিঙের মতো পাখী গুলো মাঠের বুক থেকে পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। শীতের ভোরের নরম আলোয় সামনে থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে কুয়াশার পর্দা কাক ডাকছে, ডাকছে আরও কতো রকম পাখী। শুন্য গগনে পাক খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চিল শকুনের দল। ডাইনে বাঁয়ে  যেদিকে তাকাও মাঠের সীমানার বাইরে বহু দূরে পটে আঁকা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছের সারি।আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হাটের পানে এগিয়ে চলেছে অতসীভুবন  পুরের গঞ্জে হাট  বসে সপ্তাহে দুদিন,সোম আর শুক্কুর বার। অন্যান্য দিনে  অতসী আর যা করে করুক না কেন, হাট বারে  ওর কিন্তু হাটে আসা চাই ই চাই। প্রথমত এখান থেকেই ও ওর ফেরির মাল প্ত্র গুল কেনে। দ্বিতীয়ত হাটে এ দোকান সে দোকানের ফাই ফরমাজ খেটেও দু চার পয়সা জোটে তারহাটে পৌঁছে প্রথমে সে ডাক বাক্সে চিঠিটা ফেললে, তারপর গেল বিশু জ্যাঠার  দোকানে। তার মা  ও  এখান থেকেই মালপত্র নিত। বিশুজ্যাঠা অতসীকে দেখে বললে – এতক্ষণে এলি রে  মা ?  এদিকে দেখ  না বলাইটা আজ কাজেই আসেনি। একা আমি আর কত দিক সামলাই বল ? ওদিকে নতুন মাল গুলো সহর  থেকে নৌকোয় এসে গুদমে পড়ে  রয়েছে  গুছিয়ে রাখার লোক ও নেইঅতসী হাসি মুখে বললে- আচ্ছা আমি দোকানে বসছি, তুমি গুদম থেকে ঘুরে এসখানিকক্ষন পরে বিশুজ্যাঠা ফিরে আসতে তার সঙ্গে কাজের কথা সেরে, অতসী গেল পরাণ হাজরার দোকানে।  হাজরা মোশাই ও এটা সেটা বলে তাকে দিয়ে দোকানের কিছু কাজ করিয়ে নিলেন। আসলে ওর মতো একজন সহায় সম্বল হীনা অনাথা  নারীকে হাতের কাছে পেয়ে যে যার মতো খাটিয়ে নেয়। কেউ কিছু দেয়, কেউবা কিছুই দেয় না।ও যেহেতু গরীব  আর এইসব দোকানদারদের কাছ থেকে ধারে মাল নিইয়েই ওর চলে,তাই বলার কিছু নেই, করার ও কিছু নেই।এখনও অন্যায় আব্দার কেউ করেনি, তবে করলেই হল। এ ভাবেই চলবে ওর জীবন।এরপর ননী পালের দোকান থেকে যেই না ও বেরিয়েছে সামনে পড়ল বিপিন ঘটক। ঘটক মশাই এর কাজ ঘটকালি করে বেড়ান। অতসীকে সামনে পেয়ে সে বললে-“এই যে মেয়ে, তোরেই খুঁজতে ছিলাম। তা বলি বে থা কিছু করবি, না সারা জীয়নটা  ওমনি গাঁয়ে গাঁয়ে নেচে বেড়াবি? এদিকে পাঁচ জনে  তো পাঁচ কথা বলে বেড়াচ্ছে ? অতসী হেসে বললে- খেয়েদেয়ে যাদের কাজ কম্ম নেই তারাই অমন এর তার নামে বলে বেড়ায়। এই আমি বেশ আছি। নিজে কামাচ্ছি নিজে খাচ্ছি। কোন ঝুট ঝামেলা নেই। আর আমি আমার নিজের গতরে খেটে খাই, কে কি বলল তাতে  কিছু যায় আসে না আমার– আহা সে তোর কিছু না এলে গেলেও, আমাদের সমাজ বলে তো একটা  কিছু আছে?না কি  নেই? তাই বলি কি ভাল একটা পাত্তর আছে।  বে করবি তো বল? অতসী অবাক হ’ল। এর আগে কেউ কোনদিন ওকে এমনি গায়ে পড়ে  বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। লজ্যায় মাটিতে মিশে গিয়ে, ও মাথা নীচু করে  কোনক্রমে বললে – না না ওসবের মধ্যে আমি নেই ।ঘটক বললে- আরে শোন শোন পাত্তর যে সে লোক লয়, আমাদের ক্ষিরীষ তলা গাঁয়ের সতীশ মোড়ল। গেল বছর ওর পরিবারটি  মরে যেতে বড্ড কষ্টে আছে বেচারা অনেক গুলো ছেলে মেয়ে তো?  তাদের মুখচেয়েই আবার বে করতে চাইছে। তাই আমায় বলছিল......। তাকে শেষ করতে না দিয়ে অতসী  মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠল - উনারে আমি চিনি।উনার বয়স তো তিন কুড়ি হলআর  আমার থেকে ও  বড় বড় ছেলে মেয়ে আছে ওনারঘটক বললে -না না তিন কুড়ি  হবে কেন? হ’লে বড়জোর কুড়ি দুই  আড়াই  হোতি পারে। আর ছেলে মেয়েরা বড় তো কি? যাকে বলে একেবারে জমজমাট সংসার, তোকে তারা খুব যত্ন আত্তি তে রাখবে অমন  সরেস মালদার পাত্তর তোর  জুটবে কী ? থাকিস তো জঙ্গলে  কুঁজি  ঘর বেঁধে।এদিকে তোর বাপের......। অতসী জানে এরপর ঘটক আর কি বলবে। সে তাই হনহন করে  সেখান থেকে হাঁটা দিলে।শুনতে পেল ঘটক মশাই  পিছন থেকে তখনও বলে চলেছে- এই শোন তাড়াহুড় নেই ভাল করে ভেবে দেখিসবিপিন ঘটক লোক ভাল নয়সে পিছন থেকে চেঁচিয়ে অতসীকে ওকথা বললেও,মনে মনে বললে- দাঁড়া  মাগী থাকিস ত জঙ্গলে,আর গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াস একা একা।জালে যখন ফাঁসাব তখন বুঝবি।

অতসী গিয়ে  বসল কেষ্ট ময়রার  দোকানের  বেঞ্চির এক কোনে। আজ ঘুরে ফিরে  খালি মায়ের কথা  মনে পড়ছে ওর, আর মনটা খারাপ  হয়ে যাচ্ছে। আজ মা থাকলে ওই ছোটলোক ঘটকটা ওর  সঙ্গে ওই ভাবে কথা বলার সাহস পেত না।  উদাস হয়ে ও যখন তার মায়ের কথা ভাবছে, সেই সময় ভাল শাড়ি কাপড় পরা, সাজগোজ করা, প্রায় ওর সমবয়সী একটা মেয়ে,ওর গা ঘেঁষে  পাশে এসে বসল।  অতসী অন্যমনস্ক ছিল বলে প্রথমটা খেয়াল করেনি। খেয়াল করল, যখন সে  কথা  কইল।–হ্যাঁরে  তুই অতসী না ?  অতসী চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে যাকে দেখল, চিনতে পারল না।  কোনদিন  কোথাও  তাকে দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না। অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।  -চিনতে পারলি না ?আরে আমি রমা ?  পূব গাঁয়ের রমা, অনেক বছর আগে তুই তোর মায়ের সঙ্গে আসতি না আমাদের গাঁয়ে ? তোর মা জিনিষ ফেরি করত, আর তুই তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতি ? মনে পড়ে ?  এবার অতসী বললে – তা মনে পড়বে না কেন ? তবে তোমায় কিন্তু ঠিক......? তাকে শেষ করতে না দিয়ে  রমা হেসে বললে– আমায় ঠিক চিনতে পারছিস না তো? তা তো হবেই, সে তোর আর দোষ কি বল ? বিয়ে হয়ে থেকে বছরে শুধু একবার এই মাঘ মাসটাতেই যা বাপের বাড়ি আসতে পারি। বাকি  সারাটা বছর বোম্বাই য়েই কাটাতে হয়। বোম্বাই এর নাম অতসী শুনেছে বটে, তবে সে দেশটা যে কোথায় কতদূরে তা সে জানে না। জিজ্ঞাসা না করে পারল না  যে সে দেশ এখান থেকে কত দূরে, এবং কিভাবে যেতে হয়?  রমা হেসে বললে –সে অনেক দূর, রেলে চেপে যেতে হয়। যাবি তুই আমার সঙ্গে?  ওখানে আমার খাওয়াদাওয়া পয়সাকড়ি অঢেল, কিন্তু কথা বলার একটা লোক পাইনা। তুই গেলে বেশ হবেঅতসী বললে- না বাবা, এখানেই আমি বেশ আছি। আসে পাশের পাঁচটা গাঁয়ের মানষে   আমায় চেনে। বিপদে আপদে সাহায্যও পাব।মায়ের হাতে গড়া ঘর আর জঙ্গল ছেড়ে আমি কথাউ যাব না রমা গম্ভীর গলায় বললে – সে তোর ইচ্ছা। যাবি তো যাবি, না যাবি তো না যাবি।কিন্তু তুই যে ভাবছিস এখানে সবাই তোকে ভালবাসে? আর আপদে বিপদে দেখবে? সেটা বোধহয় ঠিক নয়।সত্যি বিপদে কখনো পড়লে তা বুঝবি। আসি রে, সামনের সোমবার পর্যন্ত আছি। ভেবে দেখিস। হাওয়ায় উগ্র সহুরে গন্ধ  ছড়িয়ে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে গেল রমাযাবার সময় মনে মনে বললে- সোজা আঙুলে  ঘী উঠবে না মনে হচ্ছে।আমাকে ত তুমি চেন না?পিছনে এমন লোক ফিট  করে দেব, যে টোপ তোমায়  গিলতেই হবে।রমা উঠে যেতে তার জায়গায়  আধ ময়লা মোটা ধুতি পরে যে লোকটা এসে বসল, অতসী তাকে  রঘু কাকা  বলে ডাকে। রঘুও অতসীর মতোই ফেরি ওয়ালা। হাটে সে কড়াই মুড়ি ফেরি করে অতসীর মা তাকে দাদা বলে ডাকত।অতসী ডাকে রঘুকাকা বলে। অতসীর কানের কাছে মুখ নিয়ে, চাপা স্বরে ফিসফিস করে রঘু জিজ্ঞাসা করল – তোকে কি বলছিল রে ওই পূব গাঁয়ের মেয়েটা ? রঘুকাকার কথা বলার ধরন দেখে একটু অবাক হল ও। তবু গলা নামিয়ে সেও ফিসফিস করে বললে –আমায় বলেছে ওর সঙ্গে বোম্বাই এ যেতে গলার স্বরটা আরও খাদে নামিয়ে রঘু বললে – খবরদার ওর সঙ্গে কোথাও যাবি না। ও হ’ল কুনকি   হাতি।ফিসফিস করে জানতে চাইল অতসী -কুনকি হাতি আবার কি ? – জানিস না ?  কুনকি হাতিরা  অন্য হাতিদের ভুলিয়ে ভালিয়ে খাদে এনে ফেলে এও তেমনি গ্রামের মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে সহরে নিয়ে গিয়ে গাড্ডায় ফেলে,তারপর তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করায় আর একবার ওর পাল্লায় পড়লে পর, ফেরার আর কোন রাস্তা থাকে না। এর আগে যারা যারা ওর সঙ্গে সহরে গেছে তারা কেউ আর ফেরে নি  

No comments:

Post a Comment