ছিন্ন মুল(৫)
প্রতি হাটবারে সন্ধ্যার মুখে পড়ন্ত বেলায় অতসী মাঠ পার হয়ে এমনি করে ঘরে
ফেরে। বেলা পড়ে এলে রাখালেরা হৈ হৈ হ্যাট
হ্যাট করে কঞ্চির ছপটি আর পাঁচনবাড়ি মেরে গোরু গুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে গোয়ালে ফে্রে। এক দেড়শ গোরুর ক্ষুরে মেঠো পথের ধুলো রেনু রেনু হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়ায়। তার উপর
পড়ন্ত বেলার হলুদ রোদ্ পড়ে মনে হয় যেন আকাশ থেকে
সোনালী রঙের মেঘরাশি মাটিতে নেমে এসেছে। একেই বোধহয় গোধূলি বেলা বলে। অতসীর মাথার উপর দিয়ে
চারি দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা সব
বাসায় ফিরছে। সন্ধ্যা নামলে সকলেরই
বাসায় ফেরার তাড়া থাকে। কিন্তু
নদীর পাড়ে খেয়া ঘাটের ওই লোকটা,
বলে কিনা তার কোন বাসা নেই। এমন অদ্ভুত কথা জীবনে কখনও শোনেনি অতসী। সে আবার বলে কিনা, লৌকোয় চড়ে ঘাটে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। লোকটাকে দেখতে ঠিক যেন বাঁশী হাতে কেষ্ট
ঠাকুরটি। ক্যালেন্ডার থেকে বেরিয়ে এসেছে। গায়ের
রঙটি মাগুরে শ্যামলা হলেও নাক চোখ মুখ ভালোই। তা সে নিজেই বা কি এমন ফর্সা? আপন মনে
বক্ বক্ করতে করতে মাঠ ভেঙ্গে ঘরে ফিরছিল অতসী। এই শেষের কথাটায় এসে ওর চমক
ভাঙ্গল। এটা কিরকম হলো?
হঠাৎ ও তার সঙ্গে নিজের তুলনা করে বসল
কেন? তাহলে কি তাকে ও তাকে.....? আর ভাবতে পারলনা সে।শরীরে মনে তার অনির্বচনীয় এক পুলক
ছুঁয়ে গেল।
খিল খিল করে
কিশোরীর মতো হেসে উঠে সে একা একা মাঝ মাঠে অন্ধকারে একটু নেচে নিলে। হাট থেকে অন্ধকারে একটি লোক ওকে
পিছন থেকে ছায়ার মতো অনুসরণ
করে আসছিল, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর নাচ
দেখল।গাঁয়ে ঢুকে প্রথমে বিশ্বেস মাসিমার হাতে পানের গোছাটা ধরিয়ে দিয়ে অতসী বনে ঢুকল। একটু দুরত্ত রেখে তার পিছন
পিছন যে আসছিল, সেও বনে ঢুকে, একটা গাছের আড়ালে
লুকিয়ে পড়ল। বনে ভোর হতে না হতেই যেমন পাখ পাখালি
কিচিরমিচির শুরু করে দেয়, তেমনি একটু অন্ধকার হলেই পাখিরা সব চুপ মেরে যায়।
তখন শোনা যায় শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা
ঐকতান, আর থেকে থেকে
শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। আজ আবার এটাসেটা
করতে গিয়ে অতসী ঘরে ফিরতে খানিকটা দেরি
করে ফেলেছে। যাইহোক ঘরে ঢুকে প্রথমে সে
তার কেরোসিনের কুপি বাতিটা জ্বালল তারপর হাত পা ধুয়ে, রোজকার মতো ইট সাজিয়ে উনুন
বানিয়ে তাতে শুখন ডালপালা গুঁজে আগুন দিয়ে
ভাত চড়াল।খাদ্য তার সামান্যই ভাতেভাত, তাই খেয়ে নিয়ে সে বসল এক গাছ তলায় পা ছড়িয়ে।যদিও
মা ওকে পই পই করে বলত- দেখ অতসী দিনমানে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তুই যা করিস তা করিস,সূর্য
ডোবার পর কিন্তু জঙ্গলে আর ঘুরবি না।অতসী কিন্তু মোটেই ঘরে থাকতে পারে না।তার দম
বন্ধ হয়ে আসে। তাই সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর
খানিকক্ষন সে খোলা আকাশের নিচে,গাছ তলায় বসে।আজও বসে বসে সে ভাবতে লাগল সারা দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। কিন্তু সবকিছু ফেলে বারবার ওর সেই খেয়া
ঘাটের ঘটনাটা, আর সেই কানাই না নিতাই কি যেন নাম ছেলেটার? তার কথাই ঘুরে ফিরে মনে
পড়তে লাগল। ক্ষণে ক্ষণে তার
মুখটাই শুধু চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আর তার কথা ভেবে শরীরে মনে পুলক জাগছে, আবার অন্ধকারে
একা গাছ তলায় বসে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠছে তার মুখ খানি। কখনও বা পাপ বোধের সঙ্গে একটু ভয় ভয় ও করছে ওর।যাবে নাকি খেয়া ঘাটে গল্প শুনতে? খেলনা ব্যায়লাটা ত সে
অনেক দিনই বাজাচ্ছে, রোজ কত লোকে শুনছেও, কিন্তু কৈ কেউ ত কোনদিন এভাবে ওর প্রশংসা
করেনি? অতসী এবার নিজেকে নিজে ধমকে উঠল।
- আঃ কি যাতা ভাবছিস লো পোড়ারমুখী?কোথাকার কে একটা ছোঁড়া?হেসে একটু মিষ্টি করে
কথা বললে আর অমনি তুই গলে গেলি?কে জানে
কি আছে তার মনে?খবরদার বলছি যাবি না তুই খেয়া ঘাটে।–আহা কি হবে গেলে?খেয়ে ফেলবে
নাকি? এইভাবে কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজে ঝগড়া করতে করতে, হঠাৎ তার খুব হাসি পেল, জোরে খিল খিল করে হেসে উঠল ও।আর সঙ্গে সঙ্গে খুব কাছ থেকে কে একজন ধুপ ধাপ শব্দ করে ছুটে
পালাল।অতসীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।কে লুকিয়ে ছিল ওখানে? আর হঠাৎ ছুটে পালালই বা কেন? জীবনে এত ভয় কোনদিন পায়নি ও। উঠে
দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল।তবু
ভয়টা কিন্তু যাচ্ছেনা।শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর ভাবছে যে কি মতলবে লোকটা বনে
ঢুকেছিল কে জানে? তবে যদি কোন বদ মতলব তার থেকেই
থাকে, তবে একা মেয়েমানুষ তার হাত থেকে সে বাঁচবে কিভাবে?এই ত তার দরমার
ঝুপড়ি?এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।কিন্তু ভোর রাত্রে মাকে স্বপ্নে
দেখে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। কি যেন বলার চেষ্টা করছিল মা?ও বুঝে উঠতে পারেনি।
No comments:
Post a Comment